ইসি গঠন নিয়ে সংলাপ কার্যত ‘আনুষ্ঠানিকতা’

সার্চ কমিটির মাধ্যমে এর আগে দুটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এবারও ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সুযোগ নেই।

নির্বাচন কমিশন ভবন
ফাইল ছবি

নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সংলাপ শুরু হচ্ছে আগামী সোমবার থেকে। ইতিমধ্যে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ) সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিক যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাতে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়টিকে ‘মতবিনিময়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৪–দলীয় জোটের একাধিক নেতা বলছেন, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ বা মতবিনিময় কার্যত ‘আনুষ্ঠানিকতা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। সংলাপের মাধ্যমে নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। এর আগে দুবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এবারও ব্যতিক্রম কিছু ঘটার সুযোগ নেই।

২০১৬ সালের শেষ দিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একইভাবে সংলাপ শুরু করেছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এক মাসের বেশি সময় ধরে সেই সংলাপ চলে। তখন রাষ্ট্রপতি সব দলের কথা শুনেছেন, সৌজন্য দেখিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকারবিরোধী কিংবা নাগরিক সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে ১৪–দলীয় জোটভুক্ত একটি দলের প্রধান নেতা প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আছে। তবে তিনি আওয়ামী লীগের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে কিছু করবেন বলে মনে হয় না। তিনি হয়তো নানা আশ্বাস দেবেন, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনে ক্ষমতাসীন দলের পছন্দই প্রাধান্য পাবে।

আগের দুই দফায় (২০১২ ও ২০১৭ সালে) মূলত আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরিক দলগুলোর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, এমন আলোচনা রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে। দুটি নির্বাচন কমিশনই (ইসি) ব্যাপকভাবে বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা ও ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশ–বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি হয়েছে বলে বিরোধী দলগুলো বলে আসছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি।

আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা মনে করেন, রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরু হলে দেশের রাজনৈতিক তৎপরতা আলোচনার টেবিলে গড়াবে। এতে রাজনৈতিক উত্তেজনা কিছুটা কমবে। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠানো নিয়ে বিএনপি মাঠ গরমের যে চেষ্টা করছে, তাতে ছেদ পড়বে। এ ছাড়া বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মুরাদ হাসানকে নিয়ে আলোচনা, ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের একটি পর্বে ‘মুজিববর্ষ’ ভুল বানানে লেখা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সরকারের যে সমালোচনা হচ্ছে, সেসবও মিলিয়ে যাবে।

সংলাপের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পার্টি ও জাসদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। রোববার কিংবা সোমবারের মধ্যেই অন্য দলগুলোকে চিঠি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, প্রথমে এক দলের সঙ্গে সংলাপ হবে। পরে একই দিনে একাধিক দলের সঙ্গেও সংলাপ হতে পারে।

■ আগামী সোমবার বঙ্গভবনে সংলাপে অংশ নেবে জাপা। ■ বুধবার সংলাপে যাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। ■ সোমবারের মধ্যে আরও কয়েকটি দল সংলাপের চিঠি পাবে।

সরকারবিরোধী দলগুলোর একাধিক সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতির সংলাপ থেকে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের আশা তারা করছে না। বরং সার্চ কমিটিতে কারা থাকছেন এবং পরবর্তী সময়ে এই কমিটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে কতটা গুরুত্ব দেবে—এর ওপরই রাজনৈতিক পরিবেশ নির্ভর করছে। খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে এমনিতেই মাঠে আছে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ইতিবাচক কোনো দিকনির্দেশনা না পেলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আরও কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে। তখন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ বাড়বে।

জাতীয় পার্টির আটজন সংলাপে অংশ নেবেন

আগামী সোমবার বিকেল চারটায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে বসবে জাতীয় পার্টি। আর বুধবার ডাকা হয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ)।

সংলাপের বিষয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শনিবার (আজ) বৈঠকে বসবেন। দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নেওয়া। তিনি জানান, সংলাপে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলে আটজন থাকবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব দেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে শনিবারের বৈঠকে আলোচনা হবে।

দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। নিবন্ধিত সব দলকেই সংলাপের জন্য ডাকা হবে কি না. তা এখনো নিশ্চিত নয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এর আগেরবার ৩১টি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে ডেকেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এবারও হয়তো গুরুত্ব বিবেচনা করে এসব দলকেই ডাকা হতে পারে। ২০১৬ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ১০ জন কিংবা এরও বেশি প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে তাঁরা সংবিধানের আলোকে আইন ও বিধি তৈরির পক্ষে। কিন্তু যেহেতু এবার সময় নেই, তাই সার্চ কমিটির মাধ্যমে শক্তিশালী একটি নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতিকে সহযোগিতা করবেন তাঁরা। আজ–কালের মধ্যে দলের বৈঠক ডেকে সংলাপের প্রস্তুতি নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর দুই বছরের মতো বাকি আছে। নির্বাচন কমিশন গঠনে বিরোধীদের দলগুলোকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে একটা সমঝোতার পরিবেশ দেখাতে চাইবে সরকার। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন সামনে রেখে কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে আন্দোলন বা সরকারকে চাপে ফেলার উপলক্ষ হিসেবে নেবে।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংলাপ থেকে আমরা কিছু প্রত্যাশা করি না। কারণ, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটাই বিএনপির অবস্থান।’

রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে বিএনপিকে এখনো আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানান মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, সংলাপের চিঠি পেলে বিষয়টি নিয়ে দলে আলোচনা হবে। এরপর যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত।