ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আজ মধ্যরাত থেকে শুরু

সাগর থেকে ধরে আনা ইলিশ
ফাইল ছবি

আজ রোববার মধ্যরাত থেকে দেশের নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে  ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে বেশ কয়েক বছর ধরে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। এই সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকে। নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেরা ২০ কেজি করে চাল সহায়তা পাবেন। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় এই সহায়তা পাবেন ৩ লাখ ৭ হাজার ১২৪ জেলে।

এর মধ্যে বরিশাল জেলার ৫১ হাজার ৭০০ জন, পিরোজপুরের ১৭ হাজার ৭০০, পটুয়াখালীর ৬৩ হাজার ৮০০, ভোলার ১ লাখ ৩২ হাজার, বরগুনায় ৩৭ হাজার ৭৪ এবং ঝালকাঠিতে সহায়তা পাবেন ৩ হাজার ৮৫০ জেলে। এরই মধ্যে ৬ হাজার ৯৪২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক আনিসুর রহমান তালুকদার গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, এরই মধ্যে এসব বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট জেলায় জেলা প্রশাসকদের কাছে চলে এসেছে। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

ইলিশ গবেষকেরা বলছেন, ইলিশ মূলত সারা বছরই ডিম দেয়। তবে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এই দুই মাসের চারটি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ডিম পাড়ে। বিশেষ করে অক্টোবরের দুটি অমাবস্যা-পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এ ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর প্রতিবছর ২ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন—এই ৮ মাস জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। দুই ধাপের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশে ইলিশ উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে, তেমনি ওজন-আকারেও বেড়েছে।

বাংলাদেশে ২০০৩-০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচি শুরু করা হয়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল।

বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আসা ইলিশ বেচাকেনা চলছে
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ রক্ষায় সরকার ও মৎস্য বিভাগ এবং জেলে ও ব্যবসায়ীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি যত্নশীল হয়েছেন। আগে ইলিশ সংরক্ষণ, এর জীবনাচার নিয়ে দেশে তেমন কোনো গবেষণা, পরিকল্পনা ছিল না। এখন নানামুখী কাজ হচ্ছে, গবেষণা করে নতুন নতুন তথ্য উদ্‌ঘাটন করা হচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইলিশের অভয়াশ্রম বাড়ানো হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়িভাবে মানা হচ্ছে। এ সময়ে জাটকা ও মা ইলিশ ধরা প্রায় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে ইলিশ নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারছে। ফলে পোনা ও জাটকা বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাচ্ছে। দেশের নদ-নদীতে সারা বছর ইলিশ মিলছে। একইভাবে সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাও সুফল দিচ্ছে।

মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের হিসাবে, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ এখন বাংলাদেশে আহরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পরই ইলিশের উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে আছে ভারত। ৫ বছর আগে দেশটিতে বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হতো। তবে চলতি বছর তাদের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মিয়ানমারে উৎপাদিত হয়েছে ৩ শতাংশের মতো। ইরান, ইরাক, কুয়েত ও পাকিস্তানে উৎপাদিত হয়েছে বাকি ইলিশ।

২০১৬ সালে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে ইলিশের সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন ৫ লাখ ৩০ হাজার টন হতে পারে। কিন্তু সেই পূর্বাভাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে। চার বছরেই ইলিশের উৎপাদন সর্বোচ্চ ওই সীমা অতিক্রম করে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯০ হাজার টন ইলিশের সর্বোচ্চ টেকসই উৎপাদন সম্ভব।

ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও মৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় উপকূলের ইলিশ অতিমাত্রায় আহরণ থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং তা বড় হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদন অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। এতে ইলিশের পাশাপাশি অন্য মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেয়ে সেসব উৎপাদনও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে।