ইলিশ আসতে দেরি কেন?
‘গত বছর নদী এত খালি আছিল না। এ বছর খুব খারাপ অবস্থা।’ কণ্ঠে হতাশা স্পষ্ট মো. মাসুদ রানার। তিনি ভোলার জোড়খাল মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি। ভোলা সদর উপজেলায় মেঘনার কাছ ঘেঁষে জোড়খাল। এখানে থাকে মাছ ধরার ট্রলারগুলো। সেগুলো মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে মোহনায় বা সাগরে গিয়ে ইলিশ ধরেন। টানা ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠল গত ২৩ জুলাই। ইলিশের আশায় ট্রলারগুলোর তখনই সাগরে ভাসার কথা। কিন্তু সমুদ্র উত্তাল ছিল প্রায় আট দিন। পরে মাছ ধরতে গিয়েও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এখন মাসুদ রানার আশা, আগামী পূর্ণিমা ঘিরে। মাসুদ বললেন, ‘এই পূর্ণিমায় যদি না পাওয়া যায়, তাইলে এ বছর ইলিশই পাওয়া যাইব না।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার মুখেও হতাশার কথা। কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তে সেই কাকভোর থেকে ঝাঁকাভর্তি নানা মাছের আনাগোনা হয়। বছরের এই সময়টায় মাছ বিক্রেতা আবুল কাশেমের মূল ব্যবসা ছিল ইলিশ মাছের। এবারও আছে। তবে পরিমাণে কম, দামও চড়া। কাশেম বললেন, ‘ব্যবসা জমতেছে না।’
আজ শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে এই বাজারেই কথা হলো ক্রেতা ইমরান আহমেদের সঙ্গে। এ সময় বাজারে মাছ শেষের পথে। মগবাজার থেকে এই ক্রেতা এসেছেন ইলিশ কিনতে। ৯০০ গ্রামের ইলিশ ১ হাজার ৩০০ টাকা দরে কিনে তিনি বেশ নাখোশ। গতবারের মতো ইলিশ কবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, সেই প্রশ্ন এই ক্রেতার।
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার তিন সপ্তাহ পরও ইলিশের সরবরাহ ভালো হয়নি। জেলেরা আছেন পূর্ণিমার আশায়। গবেষকেরা বলছেন, ইলিশ আসবে। হতাশার কিছু নেই। এবার খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি। ইলিশের গতিপথ পরিবর্তনেরও বিশেষ ঘটনা ঘটেনি। মাছটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। এ মাছ পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে অমাবস্যা-পূর্ণিমা, পানির গতি, ঘোলাত্ব এবং বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক কিছু কারণ থাকে। সেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
ইলিশ ধরায় দুই মাসের বেশি সময়ের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর নিম্নচাপ শুরু হয়। সে সময় জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তখন বিপত্তি বাধল। অন্তত ৮ থেকে ১০ দিন পর শুরু হলো যাওয়া। কিন্তু এরপরও ভালো ইলিশ মেলেনি। তাই সে সময়টায় ইলিশ ছিল না, তা বলার কোনো কারণ নেই বলেই বিশেষজ্ঞদের কথা। আসলে তখন সাগরে যাওয়া যায়নি বলেই ইলিশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলছিলেন, প্রায় সব ট্রলারই পাঠিয়েছিলেন। সাগরে মাছ পায়নি। মোহনায়ও মাছ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ব্যবসায়ীরা আশা, মাছ মিলবে আগামী পূর্ণিমার পর। বললেন, ‘আশার মইদ্যে বুই বেইধে আছি। নইলে যাইতামই না।’ এ আশা অনেকেরই। জেলে ও গবেষকেরাও ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে বারবার এই অমাবস্যা বা পূর্ণিমার কথা বলছেন।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ার–ভাটার প্রাবল্য সৃষ্টি হয়। মাছ এতে আন্দোলিত হয়। ইলিশের এক নাচন শুরু হয়। একেবারে ঠিক অঙ্কের হিসাব ধরে আগস্ট মাস এলেই মাছ চলে আসবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সামনের পূর্ণিমাতে খুব ভালো পরিমাণে আসবে।’
৮ আগস্ট অমাবস্যা গেছে। এর ১৪ দিন পর ২২ আগস্ট পূর্ণিমা। গবেষক আনিছুর রহমান বলছেন, পূর্ণিমার পরের সময় ইলিশের আধিক্য হবে। ইলিশ যে মিলবে এর লক্ষণ দেখা গেছে কক্সবাজারে। ছয় দিন ধরে কক্সবাজারের ফিসারিঘাটে প্রচুর ইলিশ আসছে।
ফিসারিঘাটের ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুতে এক কেজির প্রতি পিস হাজারের ওপরে বিক্রি হতো। আজ থেকে দামও কমতে শুরু করেছে। ইলিশ আরও বাড়বে বলেই আমাদের ধারণা। বিশেষ করে পূর্ণিমার পর।’
কক্সবাজারের জেলের মুখে যখন ইলিশের রুপালি ঝিলিকের মতো হাসি, তখন পটুয়াখালী-বরিশাল বা চাঁদপুরের দিকে এমন আকাল কেন?
এ বিষয়ে গবেষক আনিছুর রহমান ইলিশের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর কথা, ইলিশ একটি দল ধরে চলাচল করে। একদিকে চলতে থাকলে অন্যদিকে কেউ থাকে না। এটি অন্য মাছের মতো সব জায়গায় সব সময় থাকে না। কক্সবাজার উপকূলের পর মিরসরাই, নোয়াখালী, হাতিয়া, ভোলার চরফ্যাশনের পর পটুয়াখালীর দিকে আসতে পারে। এবার কক্সবাজার দিয়ে ইলিশের দল ঢুকেছে। প্রতিবার যে একই পথ দিয়ে আসবে, তা নয়। এমনও হয়েছে যে পটুয়াখালীর উপকূল দিয়েও ঢুকেছে।
এবার কক্সবাজারের এদিকে ইলিশ প্রথম দফায় বেশি পরিমাণে পাওয়ার ক্ষেত্রে বৃষ্টির ভূমিকা আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্পের সাবেক জাতীয় পরামর্শক মন্মথনাথ সরকার। অভিজ্ঞ এই ইলিশ গবেষকের কথা, পানির গতিবেগ বেশি না হলে উজান থেকে ইলিশ আসতে চায় না। এই গতিবেগে নদীর লবণাক্ততা কমে। ইলিশের আসার পথ সুগম হয়। এবার নাফ নদীসংলগ্ন অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তাই সে অঞ্চলে ইলিশ বেশি মিলেছে।
তিস্তার পানি বাড়ছে, ফারাক্কা দিয়েও পানির তোড় বাড়ছে। এই গতিবেগের পাশাপাশি নদীর পানিতে ঘোলাত্ব বাড়বে। সেই ঘোলাত্ব ইলিশের আসার জন্য উপযোগী, মন্মথ রায়ের মন্তব্য এই। আর বৃষ্টি, পানির গতিবেগ ইলিশের উপযোগী হয়ে ওঠায় পটুয়াখালীতে আজ থেকে ইলিশের দেখা মিলেছে বলে মনে করেন তিনি।
দুই গবেষক জানান, অমাবস্যার চেয়ে পূর্ণিমায় ইলিশ বেশি মেলে। কারণ, এ সময় জোয়ার প্রবল হয়। আগস্টের পর সেপ্টেম্বরে আবারও দুই দফা অমাবস্যা-পূর্ণিমা আসবে। তখনো ইলিশ পাওয়া যাবে। আর অক্টোবরের পূর্ণিমায় প্রজননের সবচেয়ে বড় মৌসুম। এ সময়টায় অবশ্য ইলিশ ধরা ২২ দিনের জন্য বন্ধ থাকে। তখনই হয় ব্যাপক প্রজনন।
ইলিশের আগমনের এসব খবর দিলেও গবেষকেরা কিছু শঙ্কার কথা বলেছেন। এ শঙ্কা দূষণজনিত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে।
আনিছুর রহমান বলেন, একসময় চাঁদপুরের দিক থেকে ঘোড়াশালে ভৈরবের মেঘনা সেতু পর্যন্ত ইলিশ মিলত। এখন ইলিশ সেই পথ প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। এটা হয়েছে দূষণের কারণে। তবে ইলিশের বড় ধরনের গতিপথ পরিবর্তনের কোনো সন্ধান মেলেনি। চাঁদপুরে এবং মেঘনা ও পদ্মা মিলে যে প্রবাহ, তা গিয়ে সাগরে পড়েছে। ইলিশের এই বিস্তৃত পথে দূষণ ও পলি পড়েছে। এতে স্থানীয় নদীর ইলিশের সমাগম কম হচ্ছে।
ইলিশের কম প্রাপ্তিকে সাময়িক বলে মনে করেন মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার উপপ্রধান মাসুদা আরা মমি। তিনি বলেন, ‘আমাদের অধৈর্য হওয়ার কিছু নেই। কক্সবাজারের ইলিশ ব্যাপক হারে ধরা পড়েছে। অন্য জায়গাগুলোতেও ভালো ইলিশ মিলবে বলে আমাদের ধারণা। এবার ইলিশ আসতে বেশি দেরি হয়নি।’