কম মূল্যে পণ্য দেওয়ার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ দুই কর্মকর্তা সিইও মো. রাসেল এবং তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। প্রতিষ্ঠানটিতে দেওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার দাবিতে প্রায়ই কর্মসূচি পালন করছেন গ্রাহকেরা। টাকা ফেরত পেতে তাঁরা কী কী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন এবং বিভিন্ন দেশে বিকাশমান ই–কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা এড়াতে কী কী করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ এরশাদুল করিম।
এরশাদুল করিম মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার আইন অনুষদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। নেদারল্যান্ডসের ক্লুয়ার থেকে প্রকাশিত ‘সাইবার ল’ ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক তিনি। হংকংয়ের সুইট অ্যান্ড ম্যাক্সওয়েল থেকে প্রকাশিত ‘ডেটা প্রটেকশন ল’ ইন এশিয়া’ গ্রন্থের সহলেখক এরশাদুল করিম। তিনি পিএইচডি করেছেন ন্যানোটেকনোলজি ল অ্যান্ড পলিসির ওপর। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শেখ সাবিহা আলম।
প্রথম আলো: ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন তো গ্রেপ্তার হলেন। ভুক্তভোগীদের কী হবে বলে মনে করেন?
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি ও গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়েছে দেখলাম। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪০৬ এবং ৪২০ ধারায়। মামলা করেছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তিন থেকে সাত বছরের জেল হতে পারে। ফৌজদারি আইনের অধীনে মামলা হয়েছে। দোষী ব্যক্তি সাজা পাবেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এ থেকে কোনো উপকার পাবেন না।
প্রথম আলো: প্রায় প্রতিদিনই মানববন্ধন করছেন ভুক্তভোগীরা। তাঁরা প্রতিকার পেতে কী করতে পারেন?
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: আসলে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পাবেন, তেমন আশা ক্ষীণ। তাঁরা দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮–এর অধীনে সিভিল স্যুট বা মানি স্যুট করতে পারেন। এ ছাড়া আরও কিছু আইন আছে। তাঁরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। যেমন গ্রাহকদের জন্য চুক্তি আইন, ১৮৭২; পণ্য বিক্রয় আইন, ১৯৩০; সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ ইত্যাদি। এসব আইনে কিছুটা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া দুদক মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করতে পারে। এ ধরনের মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হয়, যে টাকা নেওয়া হয়েছে, তা কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা আছে। তবে নানা আইনি বেড়াজালে একজন গ্রাহকের পক্ষে এটা প্রমাণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যদি ভুক্তভোগী অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে প্রতিকার পেতে পারেন। কিছু নিয়ম অনুসরণ করে প্রতারকদের ব্যাংক হিসাব এবং অন্যান্য সম্পদ জব্দ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিধান আছে।
প্রথম আলো: আপনি আশাবাদী নন বলছিলেন...
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: আমি খুব একটা আশাবাদী নই দুটি কারণে। প্রথমত, সিভিল স্যুট বা মানি স্যুটের ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়াটা বেশ দীর্ঘ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই মামলার যথাযথ পরিণতি নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। অন্তত আগের ঘটনাগুলো, যেমন যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দ্বিতীয়, সম্পদ জব্দ করে ক্ষতিপূরণ আদায় এখন পর্যন্ত দুরাশাই মনে হচ্ছে। আমরা পত্র–পত্রিকা মারফত জানতে পারছি যে ব্যবসায়ী বা গ্রাহকেরা যে পরিমাণ টাকা দিয়েছেন, তার তুলনায় প্রতারণায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা খুবই নগণ্য।
প্রথম আলো: যশোরে চেক জালিয়াতির একটা মামলা হয়েছে...
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: যশোরে চেক ডিজঅনারের মামলা হয়েছে। চেক ডিজঅনারের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধ প্রমাণিত হলে, আদালত দোষী ব্যক্তিকে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা হিসেবে চেকে টাকার যে অঙ্ক রয়েছে, তার তিন গুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা দুটি দণ্ডই দিতে পারেন। এতে ভুক্তভোগী কেবল তাঁর নিজের ক্ষতির সমপরিমাণ টাকা ফেরত পাবেন। বাকি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
প্রথম আলো: অপরাধটা তো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ঘটেছে, এ সম্পর্কিত কোনো আইনে প্রতিকার নেই?
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: ভুক্তভোগীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮–এর অধীনে ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক প্রতারণার জন্য মামলা করতে পারেন। অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে যিনি প্রতারণা করেছেন, তিনি সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তবে এখানেও সেই একই কথা মনে রাখতে হবে, এটি একটি ফৌজদারি বিধান। তাই এখানে যিনি প্রতারণা করেছেন, তিনি বা তাঁরা শাস্তি পাবেন। যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের কোনো লাভ হবে না।
প্রথম আলো: কেউ কেউ নতুন আইন করার দাবি করছেন, বলছেন রাষ্ট্র যেন ভুক্তভোগীদের পাওনা মিটিয়ে দেয়...
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: আমিও তাই দেখছি। কেউ কেউ এই দাবি তুলেছেন। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্র চাইলে আইন করে যাঁরা প্রতারিত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে পারে। আমি বিনয়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতে চাই। রাষ্ট্র এটা কেন করবে? রাষ্ট্রের আয় তো জনগণের করের টাকা। সেই টাকা এভাবে ব্যয় করা হলে রাষ্ট্রকেও আমাদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এটা একটা মন্দ উদাহরণ হয়ে থাকবে। ভবিষ্যতে অনেকেই এ ধরনের আইনের সুযোগ নিতে থাকবে।
প্রথম আলো: বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি কী? ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পাচ্ছেন কীভাবে?
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যেন ভোক্তাদের না ঠকায়, তা নিশ্চিত করতে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রগুলোর বেশ কিছু উদ্যোগ আছে। এ ধরনের ব্যবসায় ভোক্তাদের আস্থা এবং বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে দেশগুলো ভোক্তাদের সচেতন করছে। এর বাইরেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে অসংখ্য উদ্যোগ আছে।
ধরুন, মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কনজ্যুমার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালে ঘরে বসেই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ভোক্তা ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। দেশের প্রতিটি প্রদেশে এই ট্রাইব্যুনালের শাখা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভোক্তাদের দলগতভাবে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এতে যেকোনো একটি ভোক্তা সংগঠন প্রতারিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তার পক্ষে আদালতে মামলা করতে পারে। ইউরোপ ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো ই-কমার্সের জন্য অনলাইনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির চিন্তাভাবনা করছে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
ড. মুহাম্মদ এরশাদুল করিম: বাজার অর্থনীতিতে ভোক্তারাই বাজারের প্রাণ। কিন্তু তাঁরা সংগঠিত নন। তাই বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিপরীতে ভোক্তারা সব সময় দুর্বল অবস্থানে থাকেন। এখানেই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অবস্থান নেওয়া জরুরি। দেখুন, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, যুবক, ডেসটিনি লুকিয়ে কিছু করেনি। তারা যা কিছু করেছে, তার প্রায় সবই সরকার বা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সামনে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম প্রতিহত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমরা দেখিনি। এটা খুবই পীড়াদায়ক।
বর্তমান বিশ্বে ই-কমার্স একটি সাধারণ বাস্তবতা। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ বিশাল বাজারে ই–কমার্স খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেক বেকার ছেলেমেয়ে নিজেদের সময় এবং মেধা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। তাই ইভ্যালি বা ই–অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা মেটানো জরুরি। আস্থা ফেরাতে অংশীজনদের নিয়ে বসা দরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভালো পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাচাই করে নেওয়ার এখনই সময়।