ইভিএমের প্রয়োজন কতটা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে) অনুষ্ঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় গতকাল শনিবার এমনই ইঙ্গিত দিলেন। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই ইভিএমে ভোট নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্প্রসারণের কথা বলে আসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ পটভূমিতে ধরে নেওয়াই যায়, আগামী নির্বাচনে সব না হলেও অধিকাংশ আসনে ইভিএমে ভোট হবে।
জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোটে সব বা বেশির ভাগ আসনে ইভিএম ব্যবহার কতটা প্রয়োজনীয়? এখন পর্যন্ত বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রায় সবাই ইভিএমের বিরোধী। তাঁদের দাবি—এই মেশিনে সহজেই কারচুপি করা বা ফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব। বর্তমান ইসি গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। তাঁদের অধিকাংশই বিতর্ক থাকায় ইভিএমে ভোট না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো ইভিএমের কারিগরি ত্রুটির কথা বলছেন। যেমন দেশে এ পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। এ ব্যবস্থায় একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পর একটা স্লিপ (প্রিন্ট করা) বেরিয়ে আসে। এতে ভোটার কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখতে পারেন। কোনো কারণে ভোট পুনর্গণনার প্রয়োজন হলে এটি সহায়ক হয়। ভারতে এই ব্যবস্থা চালু আছে।
এর বাইরে ভোটের মাঠে সরেজমিনে ইভিএমের বেশ কিছু দুর্বল দিক পাওয়া গেছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেওয়া কেন্দ্রগুলোতে ধীরগতি দেখা গেছে। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে—বয়স্ক, বিশেষ করে নারী ভোটারদের আঙুলের ছাপ মিলছে না। এ জন্য ভোটই দিতে পারেননি অনেকে। নারায়ণগঞ্জে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের পরামর্শে আঙুলের ছাপ মেলানোর জন্য অনেক ভোটারকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এবং হাতে জেল মেখে চেষ্টা করতে দেখা গেছে। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ইভিএম মেশিন ব্যবহারে ভোটারদের অনভ্যস্ততার কারণেও ভোট পড়ার গতি কমতে দেখা গেছে।
ইভিএমে ধীরগতি ও ভোটার ফিরে যাওয়ার প্রমাণ মেলে ভোট পড়ার হার বিশ্লেষণে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হয়। আসনগুলো হলো ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, খুলনা-২, রংপুর-৩ ও সাতক্ষীরা-২। লটারির মাধ্যমে এই ছয়টি আসন ইভিএমের জন্য নির্ধারণ করা হয়।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ।
তবে ইভিএমে যে ছয়টি আসনে ভোট হয়েছিল, সেখানে ভোটের হার ছিল গড়ে ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ। এরপর বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও কাগজের ব্যালটের সঙ্গে ইভিএমে ভোটের হারের ব্যবধান দেখা গেছে। গত বছর ছয় পর্বের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনেও কিছু কিছু ইউনিয়নে ইভিএমে ভোট হয়। এসব ভোটে দেখা গেছে, কাগজের ভোটের চেয়ে ইভিএমে ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম ভোট পড়েছে। একই ব্যবধান দেখা গেছে পৌরসভার ভোটেও।
বাংলাদেশে যেকোনো নির্বাচন উৎসবে পরিণত করার রেওয়াজ পুরোনো। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমে ভোট হলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভোটারের ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
সর্বশেষ ব্যবহৃত ইভিএম মেশিনগুলোর তিনটা অংশ ছিল। প্রথমত, কন্ট্রোল ইউনিট, যাতে ভোট ও ভোটারদের তথ্য জমা থাকে। দ্বিতীয়ত, ডিসপ্লে ইউনিট, যেখানে সেই তথ্যগুলো প্রদর্শন করা হয়। তৃতীয়ত, ব্যালট ইউনিট, এখানে সুইচ টিপে ভোটাররা গোপন কক্ষে তাঁদের ভোট দেন।
একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্মার্টকার্ড বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট (আঙুলের ছাপ) দেওয়ার পর কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটার শনাক্ত করা হয়। এরপরই তিনি ভোটদানের জন্য বিবেচিত হন।
কিন্তু এ–যাবৎ জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের যেসব ভোটে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে, এর অনেকগুলোতেই ভোটারদের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অধিকাংশ অভিযোগ ছিল, গোপন কক্ষে আগে থেকেই সরকার দলের লোকজন অবস্থান করছিলেন। ভোটার নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে ব্যালট ওপেন করার পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তি আগেই বাটন চেপে দিচ্ছেন। বিশেষ করে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউপি ভোটে মেয়র ও চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীদের বেলায় এই অনিয়ম বেশি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে গোপন কক্ষে থাকা সরকারদলীয় লোকজন ভোটারদের শুধু কাউন্সিলর ও সদস্য পদের ভোটটি দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ইভিএমে ভোট গ্রহণের আলোচনা জোরালো হয়। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের কিছু কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করা হয়। পরে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয় ২০১২ সালে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে। এরপর যতবারই ইভিএমে ভোটের কথা এসেছে, এর বিরোধিতা করেছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। আর এর পক্ষে জোরালো সমর্থন দিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীনদের যুক্তি—এটি আধুনিক পদ্ধতি, ফল গণনাও সহজ।
২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৩ আসনে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধীরা অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। এমনকি ৩০ ডিসেম্বরের ভোটের আগের রাতে ব্যালট ভরে রাখার অভিযোগ উঠেছে। গত এক যুগে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনেও জবরদস্তির মাধ্যমে এবং অনেক স্থানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ফলে ভোট নিয়ে একধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিভক্ত রাজনৈতিক সমাজে একতরফাভাবে ইভিএম চাপিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ইভিএম যদি সাধারণ ভোটারদের ভোটদানের জন্য সহায়ক না হয়, তাঁরা যদি সাদরে গ্রহণ না করেন, তাহলে বিপুল খরচ করে এই যন্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।