আলুটিলার ত্রিপুরা পল্লিতে শারদোৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি
শরতের মনপ্রাণ মাতানো কাশবন, আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা ও শিউলি ফুল জানান দেয় এসেছে শারদীয় দুর্গোৎসব। শরতের শুভক্ষণেই বছর ঘুরে দুর্গা আসেন সবার ঘরে ঘরে অফুরন্ত আনন্দবার্তা নিয়ে। দুর্গার আগমনের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ‘পথের ঠিকানা’র অভিভাবক হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার শারদোৎসব ভাগাভাগি করে নেব দুস্থ অসহায় পাহাড়ি ত্রিপুরাদের সঙ্গে।
যেই ভাবা সেই কাজ। পথের ঠিকানা সামাজিক সংগঠনের একঝাঁক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা করি পাহাড়িদের চিকিৎসাসেবা, বিনা মূল্য ওষুধ, দুপুরে একবেলা প্রসাদের ব্যবস্থা করে একটি দিন কাটাব তাদের সঙ্গে। এক মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পথের ঠিকানার সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আয়োজন করি ত্রিপুরাদের শারদোৎসব।
শুভ মহালয়ার দিন আমরা ভোরবেলায় রওনা হলাম খাগড়াছড়ির আলুটিলার অচৈইপাড়া গ্রামের উদ্দেশে। সব সদস্য হইহুল্লোড়-চিৎকার-আনন্দে গন্তব্যে রওনা হই, গাড়ি পাহাড়ের কাছাকাছি গিয়ে আর তো যায় না। নেমে শুরু হলো হাঁটা। দূরত্বটা কিন্তু কম নয়। ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ। পাহাড়ের চারদিকে শান্ত পরিবেশ, রৌদ্রের খানিকটা উত্তাপে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও হিমেল হাওয়ার পরশে শীতল করে দেয় শরতের নীল আকাশ। মাথার ওপর সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে, হাঁটতে শুরু করি কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে। কিন্তু তরুণেরা এগিয়ে যাচ্ছে উদ্দাম গতিতে, তাদের গতি দেখে আমিও কিছু শক্তি পাই এগিয়ে যাওয়ার। মনে মনে ভাবছি, বয়সটা বেড়ে গেছে। অনেকটা পথ হেঁটে ক্লান্ত শরীরে পৌঁছে গেলাম অচৈইপাড়া গ্রামে। দেখে অবাক হলাম, সবাই শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাদের কোনো তাড়া নেই, বিরক্তির কোনো ছাপ নেই। গ্রামের পৌঁছার পর আয়োজক অর্পণ ত্রিপুরা আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁদের কষ্টে তৈরি করা ত্রিলোচন শিবমন্দিরে।
আমাদের শত কষ্ট মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল পরম আতিথেয়তায় ও শিবমন্দির দর্শনে। শিবমন্দিরটি সমতল থেকে ১ হাজার ৩০০ ফুট ওপরে। সেই পাহাড় থেকে পর্যবেক্ষণ করলাম পুরো খাগড়াছড়ি। দেখা গেল দূরের ভারতসংলগ্ন পাহাড়গুলো। অর্পণ ত্রিপুরাসহ অন্যদের মুখে বর্ণনা শুনলাম রাতের পরিবেশের। মনোমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম তাদের কথা। ইচ্ছা জাগল রাতে থেকে যাওয়ার! মন্দিরে প্রণাম করে চলে গেলাম অপেক্ষারত পাহাড়িদের চিকিৎসাসেবা শুরু করতে। আমি একা চিকিৎসক এতজনকে একসঙ্গে চিকিৎসা, তারপর তাদের ভাষা বোঝা, সব মিলিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তাদের ধৈর্য, সহনশীলতা, ত্রিপুরা ভাষা অনুবাদকারীর সহযোগিতায় ২৫০ জন ত্রিপুরার চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলো। তাদের দেওয়া হয় বিনা মূল্য ওষুধ। তারা এত সুশৃঙ্খলভাবে তাদের সেবা নিচ্ছে, দেখে আমি মুগ্ধ।
ওরা বুঝতে দেয়নি যে, আমি এত মানুষের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। দুপুরে গড়িয়ে গেল, তাদের জন্য আয়োজন ছিল দুপুরের খাবারের। আহারের পর তাদের জন্য ছিল বস্ত্র বিতরণ, সুশৃঙ্খলভাবে তারা গ্রহণ করল তাদের বস্ত্র। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ মতবিনিময়ের সুযোগ হলো। শুনলাম তাদের কথা, এত কষ্টের মধ্যে কেউ অভিযোগ করেনি ডিজিটাল বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে শত সুযোগ থেকে তারা আজও বঞ্চিত কেন। তাদের পানীয় জলের অভাবের কথা। তাদের সব কথা শুনে বুকের মধ্য একটা কষ্ট বোধ হলো। আমরা এই কোন দেশে বাস করি, সরকারের হাজারো কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায়। অথচ গ্রামগঞ্জে, পাহাড়ে এই অসহায় মানুষগুলো চিরকালই রয়ে যায় সব সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। যদিও তারা চায় না সেসব সুযোগ-সুবিধা। তারা চায় একটু মানব-সহায়তা, যা তাদের সুস্থ-সবলভাবে বাঁচিয়ে রাখবে। চায় একটু পানীয় জল, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুব্যবস্থা।
পাহাড়ের গভীরে না গেলে কোনো দিনও বুঝতে পারতাম না পাহাড়িদের কষ্ট। মনে হলো পাহাড়-পাহাড়িরা যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পাহাড়িরা ছাড়া যেমন পাহাড় বাঁচবে না, তেমনি পাহাড় না বাঁচলে বাঁচবে না প্রকৃতি। প্রকৃতির কোলে তারা যেন সন্তানের মতো, তাই তাদের ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পুষিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে ভাবতে লাগলাম তাদের কথাগুলো। বিকেল গড়িয়ে গেল, সূর্যমামা অস্তমিত হয়ে আমাদের বিদায় জানাতে লাগল। আমরাও পাহাড়িদের বিদায় দিয়ে চলতে লাগলাম, একা পাহাড়ের মেঠোপথ ধরে চলতে লাগলাম, শরতের আকাশের সাদা মেঘগুলো চলে গিয়ে সূর্যাস্তের রঙে ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম আকাশে, বারবার হিমেল হাওয়ার পরশ ভুলিয়ে দিচ্ছে আমার ক্লান্তি। আমি কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি।
ঝিঁঝি পোকারা সুর করে ডাকতে শুরু করতে রাতের আয়োজনে, কথা হচ্ছে মন ও প্রকৃতির মাঝে। মনে মনে প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করে কথা দিলাম, আমি আসব তোমার পানে তোমার টানে তোমার সনে। হঠাৎ করে কে যেন ডেকে উঠল, দাদা কই? আসেন আসেন, তখন বুঝতে পারলাম সত্যি যেতে হবে। না হলে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম, কিন্তু মনটা কেন জানি পড়ে রয়েছে পাহাড় ও পাহাড়িদের মাঝে। পথের ঠিকানার অভিভাবক হয়ে পাহাড়িদের মাঝে আমাদের শারদোৎসব ভাগাভাগি করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে। আমরা পেরেছি, আমরা পারব। ভবিষ্যতে পথের ঠিকানা আরও কাজের প্রত্যয় নিয়ে মানবসেবায় এগিয়ে যাবে।
ডা. যীশুময় দেব, সভাপতি, পথের ঠিকানা, চট্টগ্রাম।