আ.লীগ ফিরে যাক মানুষের কাছে, চান বিএনপির সাংসদ
বিএনপি থেকে নির্বাচিত সাংসদ জি এম সিরাজ বলেছেন, সরকারি দলের সর্বস্তরের নেতারা গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বিচারহীন দেশে তাঁরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনকি চলমান সংসদের অন্তত এক ডজন সাংসদ দুর্নীতি, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, অর্থ পাচার, মানব পাচার, মানব ব্যবসায় জড়িত সরকারের প্রশ্রয়ে। তাঁদের কোনো জবাবদিহি নেই।
আজ রোববার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে জি এম সিরাজ এসব কথা বলেন। সিরাজের এই বক্তব্যে সংসদে কিছু সময়ের জন্য উত্তাপ ছড়ায়। হইচই করে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান সরকারি দলের, বিশেষত নারী সাংসদেরা। অবশ্য তাঁর বক্তব্যের শুরু থেকেই বিভিন্ন কথার জবাবে হইচই করে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন সরকারি দলের সাংসদেরা। একপর্যায়ে স্পিকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বিএনপির সাংসদকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে সরকারি দলের প্রতি আহ্বান জানান এবং পরে জবাব দেওয়ার অনুরোধ করেন। সিরাজের বক্তব্য শেষে ফজলে রাব্বী মিয়া নিজেই ওই সাংসদের বক্তব্যের জবাব দেন।
সিরাজ বলেন, ‘এবার এসে দেখলাম আওয়ামী লীগের পলিটিক্সের ক্যারেক্টার চেঞ্জ হয়ে গেছে। মাননীয় স্পিকার, আমি আপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ আবার ফিরে যাক মানুষের কাছে। আওয়ামী লীগ ফিরে যাক ভালোবাসার কাছে। ভয়ভীতি এসবের চর্চা বাদ দিয়ে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করার জন্য, আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং আমার নেতা বসে আছেন আমার সামনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, আসুন, মানুষের ভালোবাসা অর্জন করি। মানুষের কাছে যাই এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিই।’
বক্তব্যের শুরুতে জি এম সিরাজ বলেন, রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করেননি, এটা দুঃখজনক। তিনি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেন। সরকারি দলের সদস্যরা হইচই করে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ সময় একজনকে ‘পক্ষে ঘোষক’ বলতে শোনা যায়।
জি এম সিরাজ বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের কেলেঙ্কারি এখন সারা বিশ্বে আলোচিত। ২০০টি দেশে করোনার সংক্রমণ হয়েছে। কোথাও ভুয়া সনদ দেওয়া হয়নি। রিজেন্ট, জেকেজিসহ ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে সরকারি দলের লোকেরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে প্রতারক রাষ্ট্র বানিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাঁচ বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মিঠু-আফজাল-রাজ্জাক-জাহের-সাজ্জাদ-হুমায়ুন সিন্ডিকেট।
সরকারি দলের সদস্যরা এই বক্তব্যেরও তীব্র প্রতিবাদ জানান। এই সময় একজন সাংসদকে বলতে শোনা যায়, ‘লেখে দিছে কে রে?’
জি এম সিরাজ বলেন, ভাবতে অবাক লাগে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন গাড়িচালক আবদুল মালেক ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। মালেকরা দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের খুদে মডেল মাত্র। ছোট–বড় সহস্র মালেক গোটা দেশকে আজ গিলে খাচ্ছে। অধরা রয়ে গেছে পৃষ্ঠপোষক কে এবং কারা। তবে এটা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট যে তাঁরা সরকারের মদদপুষ্ট এবং সরাসরি সম্পৃক্ত।
বিএনপির এই সাংসদ বলেন, প্রতিবছর গড়ে ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। মূলহোতা বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই থেকে বর্তমানে প্রশান্ত কুমার হালদার পর্যন্ত সবাই সরকারের ঘনিষ্ঠজন। একজন হলেন এই সংসদের সাংসদ পাপলু (পাপুল)। তাঁকে কুয়েত সরকার চার বছরের জেল দিয়েছে। শুধু সংসদ নয়, তিনি পুরো দেশকে কলঙ্কিত করেছেন।
নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করে জি এম সিরাজ বলেন, ভোটের মালিক আওয়ামী লীগ, পুলিশ প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশন। যেকোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মানে ‘উইন সার্টিফিকেট’। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে এসব প্রহসনের নির্বাচনে কী লাভ।
সরকারের উদ্দেশে সিরাজ বলেন, ‘এক নায়কতন্ত্র আর গণতন্ত্র পরস্পরবিরোধী। অতএব বর্তমান সরকারকে যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে। গণতন্ত্রের মিথ্যা বুলি বাদ দিয়ে অঘোষিত বাকশালের পথ পরিহার করে সরাসরি বাকশাল সরকার প্রতিষ্ঠা করা হোক। নতুবা দেশের মালিক জনগণকে দেশ ফিরিয়ে দিন।’
রাষ্ট্রপতির ভাষণের একটি লাইন উল্লেখ করে জি এম সিরাজ বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ নির্মূল, শিক্ষা, তথ্য প্রযুক্তির জন্য তিনিও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চান। তিনি এসব অস্বীকার করেন না। কিন্তু সুশাসন আর গণতন্ত্র নেই। মানুষ রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সত্য ভাষণ শুনতে চায়।
সাংসদেরা হইচই করে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ সময় জি এম সিরাজ বলেন, তাঁরা সংখ্যায় কম হলেও দেশের মানুষ, স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের বক্তব্য শুনতে চান। কিন্তু সংসদ সদস্যরা অযথা হইচই করছেন। এটা গণতান্ত্রিক চর্চা নয়। ’৯৬ সালেও তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন। তখনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। তখন এমন চর্চা তিনি দেখেননি।
সিরাজের বক্তব্যের পর ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, জি এম সিরাজ রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন, যা সঠিক নয়। এগুলো এক্সপাঞ্জ করা যায় কি না, তিনি চিন্তা করে দেখবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যে চর্চার কথা বললেন, এই চর্চায় আমার গায়ে গ্যালারি থেকে থুতুর চর্চাও আপনারা ১৯৯১ এবং ২০০১-এ দেখিয়েছিলেন। আমার গায়ে থুতু...তখন আমি আওয়ামী লীগে ছিলাম না। তখন আমি জাতীয় পার্টি করতাম। আমার গায়ে থুতু দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগকে হেইল করে বিএনপিকে অ্যাটাক করে বক্তব্য দিয়েছিলাম, আমার গায়ে থুতু দেওয়া হয়েছিল। এই প্র্যাকটিসও কিন্তু আপনারা আমাদের দেখিয়েছেন।’
সব দলের সদস্যদের সহনশীলতা দেখানোর আহ্বান জানান ডেপুটি স্পিকার।