রাবির হলে বেপরোয়া ছাত্রলীগ
আর লাঞ্ছিত হতে চান না প্রাধ্যক্ষরা
পাঁচ প্রাধ্যক্ষ বলেন, তাঁরা চান, বৈধ শিক্ষার্থীরা হলের সুযোগ-সুবিধা পাক। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য করেন।
ছাত্রলীগ নেতারা যখন যে দাবি করেন, তখনই সেটা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন প্রাধ্যক্ষরা।
হলে সিট–বাণিজ্য ও কক্ষ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ছাত্রলীগের নেতাদের কারণে হলের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন অন্তত পাঁচটি হলের প্রাধ্যক্ষরা। নানাভাবে তাঁরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। তাঁরা আর লাঞ্ছিত হতে চান না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে প্রাধ্যক্ষরা এ পদে থাকবেন না বলে জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঁচ প্রাধ্যক্ষ বলেন, তাঁরা চান, বৈধ শিক্ষার্থীরা হলের নানা সুযোগ-সুবিধা পাক। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে নিজেদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য করেন। না হলে বিভিন্নভাবে প্রাধ্যক্ষদের অসম্মানিত হতে হয়। এসব ঘটনায় নানাভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সব হল প্রাধ্যক্ষের রয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কাউন্সিলের আহ্বায়ক ও তাপসী রাবেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফেরদৌসি মহল প্রথম আলোকে বলেন, কোনো প্রাধ্যক্ষের কাছ থেকে হেনস্তার বিষয়ে অভিযোগ পাননি। তবে বিষয়টি তাঁর কানে এসেছে। এসব নিয়ে সংবাদপত্রে খবর দেখে আগামীকাল রোববার প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভা ডেকেছেন তিনি। ওই সভায় হেনস্তা বা হলের সিট বিষয়ে প্রাধ্যক্ষদের কাছে জানতে চাইবেন। সেখানে প্রাধ্যক্ষরা এ বিষয়ে অভিযোগ করলে তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন।
গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেটে তালা দেন শামীম ওসমান নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। তাঁর তোলা অনাবাসিক এক ছাত্র শফিউল্লাহকে হল প্রাধ্যক্ষ বের করে দেওয়ায় তিনি এ ঘটনা ঘটান। এর আগের দিন ছাত্রলীগের কর্মী শফিউল্লাহ কক্ষের এক আবাসিক ছাত্রের বিছানাপত্র ফেলে দিয়েছিলেন।
অভিযুক্ত শামীম ওসমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি—তিনি নিজেও ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নন। হলগেটে তালা দেওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে আবাসিক শিক্ষক ও হলের ছাত্রলীগ নেতাদের বৈঠক হয়।
এ সময় হলটির প্রাধ্যক্ষ শামীমের বিছানাপত্র হল থেকে নামিয়ে আনতে বলেন। ওই বৈঠকে প্রাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কে হলে উঠবে, সে সিদ্ধান্ত তোমরাই নিচ্ছ! ঈদের পর ৬৮ জন শিক্ষার্থীকে হলের আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা ৯ জনের বেশি সাধারণ শিক্ষার্থীও তুলতে পারিনি। এই চেয়ারে থাকা লজ্জার। এভাবে থাকব না চেয়ারে। এখনই পদত্যাগ করব।’
এ ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বৃহস্পতিবার রাতে একটি হলের প্রাধ্যক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ কলে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শুধু প্রাধ্যক্ষকে মারতে বাদ রেখেছেন। তা ছাড়া আর সবকিছুই করেছেন। তাঁরা যখন যে ধরনের অন্যায় দাবি করেন, তখনই সেটা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন প্রাধ্যক্ষরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় বলে থাকে যে প্রাধ্যক্ষরাই হলের সর্বেসর্বা—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘আপনাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলতে পারে প্রাধ্যক্ষের ক্ষমতার কথা। কিন্তু বাস্তবে ছাত্রলীগের বিষয়ে কিছু জানালে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাউকে দায়িত্ব দেন। এরপর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ যা করেন, ছাত্রলীগের সঙ্গে একটা মিলমিশের মিটিং (বৈঠক) করিয়ে দেন। কিন্তু হল প্রশাসনকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেন না।’
ওই প্রাধ্যক্ষ মনে করেন, হলে ছাত্রলীগের সিট-বাণিজ্য ও দখলের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে ভেতরে-ভেতরে আঁতাত করে চললে সামনে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। হলের দায়িত্বে কোনো শিক্ষক আসতে চাইবেন না। এমনকি তাঁরাও থাকবেন না।
গত কয়েক দিনের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হলে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। এখানে মানসম্মান নিয়ে থাকার মতো অবস্থা নেই। অনেক প্রাধ্যক্ষই হয়তো এগুলোর শিকার।
এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময় প্রশাসনের সঙ্গে বসেছেন বলে জানান রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আবদুল মজিদ ওরফে অন্তর। তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে প্রতিবারই আশ্বাস পেয়েছেন তাঁরা। তবে সমাধান হয়নি।
অন্যান্য অভিযোগের সঙ্গে হলে সিট-বাণিজ্য ও কক্ষ দখলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁরা বড় রাজনৈতিক দল। অনেক সময় নানা ধরনের ঘটনা ঘটে যায়। সেটা তাঁরা দ্রুতই সমাধান করে দেন।
এসব বিষয়ে কথা বলতে উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে সহ-উপাচার্য মো. সুলতান-উল-ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, উপাচার্য দুই দিন রাজশাহীর বাইরে ছিলেন। গত রাতে ফিরেছেন। গত দুই দিনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো উপাচার্যকে বলেছেন তিনি। এসব বিষয়ে দ্রুত সভা আহ্বান ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি।
এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার না হন—জানিয়ে অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ঠেলাঠেলি করবে, প্রাধ্যক্ষকে মানবে না—এ অবস্থা চলতে পারে না। এটা একধরনের বিশৃঙ্খলা।