আমের নাম আনোয়ার রেতাউল

গাছে ঝুলছে আনোয়ার রেতাউল আম। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরতলির কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারেছবি: আনোয়ার হোসেন

হঠাৎ পায়ের কাছে কিছু একটা পড়ল। অপ্রস্তুত ছিলাম। ভড়কে গেলাম। পাশে থাকা স্ত্রীও ভয় পেয়ে গেল। খপ করে আমার হাত ধরল। বিয়ের বয়স মোটে কয়েক মাস। রাত প্রায় একটা। নতুন জায়গা। সবকিছু অপরিচিত। যদিও বাগানে আবছা আলো ছিল। আমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ধাক্কা সামলে নিচে তাকালাম। আম! আকারে ছোট্ট। একটু লম্বাটে গড়ন। হাতে নিতেই মুঠির মধ্যে এঁটে গেল। নাকের কাছে নিলাম। দারুণ ঘ্রাণ। আধো অন্ধকারে আশপাশে আরেকটু খুঁজলাম। পথের পাশে পেয়েও গেলাম একটি। যাক, দুটি হলো। সামনে ঘন অন্ধকার। উল্টো ঘুরে রুমের দিকে রওনা দিলাম।
স্থান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরতলির কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টার। রেস্টহাউসে উঠেছি। হানিমুন বলা যাবে না। বেড়াতে এসেছি। ২০০৬ সালের জুন মাস। আমপাকা গরম। দোতলায় উঠে বিদ্যুতের আলোয় আম দুটি দেখলাম। মায়া–মায়া চেহারা! ছোট, সরু। তার সঙ্গে যেন অনুপাত মিলিয়ে পরিমিত লম্বা। হাতের মুঠির বাইরে যায় না। চামড়া মসৃণ। ঘ্রাণটা অসাধারণ। চামড়া ছিললাম। বেশ পাতলা। মাংসের ওপরটা দেখতে বেলে। মুখে পুরে দেখলাম আঁশহীন, রসাল, মোলায়েম। একটা দারুণ অনুভূতি হলো। তৃপ্তির ছোঁয়া চোয়াল বেয়ে যেন শরীরে নামল। স্ত্রী আম বিষয়ে নিরাসক্ত। আম কম খায়। অনুরোধে সে–ও ঢেঁকি গিলল। খেয়ে আমার উচ্ছ্বাসে গলা মেলাল।  

এই আমের নাম তো জানতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিক, সহকর্মী আনোয়ার হোসেন সকালে দরজার কড়া নেড়ে ঘুম ভাঙালেন। নাশতা হবে রাস্তার পাশে। কালাইয়ের রুটি। রাতের আম বৃত্তান্ত তাঁকে জানালাম। নিরুৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘গুটি আম হবে আরকি!’ নিচে নেমে আম পাওয়ার জায়গাটা দেখালাম। হর্টিকালচারের বড় কর্তার বাসার কাছে। আমের নাম জানার আর্জি জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফিরলাম রাতের খাবার খেয়ে। ছোট এক ডালা আম এসে হাজির। সেই আম। হর্টিকালচারের উদ্যানতত্ত্ববিদ পাঠিয়েছেন। আজ আর ভদ্রলোকের নাম মনে নেই। ভরা পেটে দু–তিনটা খেয়ে ফেললাম।

গাছ থেকে আম পাড়ছেন তাঁরা। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরতলির কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে
ছবি: আনোয়ার হোসেন


পরদিন সকালের মূল কাজ আমের ঠিকুজি উদ্ধার। নামেই বাজিমাত। আমের নাম ‘আনোয়ার রাতাউল’। বলা হলো, জাতটা পাকিস্তানি। বিজ্ঞানীদের সফর বিনিময় কর্মসূচির অধীনে পাকিস্তানের কোনো প্রতিনিধি বোধ হয় নিয়ে এসেছিলেন চারা বা আঁটি। তা–ই লাগানো হয়েছে এখানে। সেটি এখন বিশাল বড় গাছ।

১৫ বছর এ তথ্যই জানতাম। বাংলাদেশে বিশেষ জাতের একটিমাত্র আমের গাছ আছে। সেই সুস্বাদু আমের প্রধানতম ক্রেতা ও ভোক্তা আমি। গর্বে পা মাটিতে পড়ে না! কিন্তু আম গবেষক মাহাবুব সিদ্দীকী সম্প্রতি সেই গর্বে পানি ঢেলে দিলেন। জানালেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপেজলার মনাকষা এলাকায় বেশ পুরোনো একটা আমবাগান আছে। সেই বাগানে আছে আনোয়ার রাতাউল আমের দুটি গাছ। পৈতৃক সূত্রে বাগানের মালিক ছিলেন প্রয়াত প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী।

পাকছে ‘আনোয়ার রাতাউল’ আম
ছবি: আনোয়ার হোসে

এবার আরেকটু খোঁজখবর করলাম। পাকিস্তান সরকারের খাদ্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় বীজ নিবন্ধন বিভাগ একটি বই প্রকাশ করেছে। ‘আ হ্যান্ডবুক অন ভেরাইটি ডেসক্রিপশন অ্যান্ড প্রোডাকশন টেকনোলজি অব ম্যাংগো’। এর ১৯ নম্বর পাতায় আছে আরাধ্য আমটির বিবরণ। বইয়ে আমটির নাম আনোয়ার রেতাউল। অন্তর্জালে ঢুকলাম। জানলাম, রেতাউল ভারতের উত্তর প্রদেশের বাঘপাট জেলার একটি গ্রাম। দিল্লি থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। আনোয়ার রেতাউল আমটির আদি নিবাস এই গ্রাম। ১৯০০ সাল থেকে সেখানে আম আবাদ হচ্ছে। আনোয়ার রেতাউল আমই ১০০ বছর ধরে এই গ্রামের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি।

জন্মস্থান ভারত হলেও আমটির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে পাকিস্তানে। সে দেশের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের প্রধান আম এই আনোয়ার রেতাউল। দেশ–বিদেশে পাকিস্তানি আমের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর এখন এই আম। আমটির নামকরণ নিয়ে দুই রকম তথ্য আছে। কোথাও বলা হয়েছে, রেতাউল গ্রামের আনোয়ার উল হক নামের একজন আমটির জাত চিহ্নিত করেন এবং এর আবাদ করেন।

গাছ থেকে আম নামিয়ে জড়ো করা হয়েছে। সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরতলির কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে
ছবি: আনোয়ার হোসেন

সে জন্য আমটির নাম আনোয়ার রেতাউল। আরেকটি তথ্য হলো, ১৯০৫ সালে শেখ মোহাম্মদ আফাক ফরিদি নামের একজন কলেজ পাস করে গ্রামে আসেন। তিনি এক বাগানে গাছটি দেখতে পান এবং বাগানিকে দিয়ে চারটি কলম করান। পরে তিনি চাকির ছেড়ে এসে ১৯২৮ সালে গ্রামে এই আমের নার্সারি করেন। তিনিই আমটির নাম দেন আনোয়ার রেতাউল। সংক্ষেপে এটি এখন রেতাউল আম নামে পরিচিত। ইন্টারনেটে রেটোল নামও ব্যবহার হচ্ছে।
সুঘ্রাণ, মিষ্টতা আর আঁশহীন বলে ভোক্তাদের কাছে আমটির কদর বেশি। আমের বিশ্ববাজারে পাকিস্তানের অন্যতম অস্ত্র আনোয়ার রেতাউল। তাদের বিজ্ঞাপন, ফলের রাজা আম। আমের রাজা রেতাউল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার কয়েক বছর আগে তাদের বাগানে মূল গাছ থেকে আনোয়ার রেতাউলের চারটি কলম লাগিয়েছে। সেগুলোয় আম ধরতে শুরু করেছে। আম গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তানের কারণে যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে আমটি ইতিমধ্যে পরিচিত, তাই বাংলাদেশে এই বিশেষ আমের বাণিজ্যিক বিস্তার হওয়া দরকার।