মশায় আমার মেয়ের যন্ত্রণাপূর্ণ নির্ঘুম রাতের দায় কার

নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাড়িতে মশা। ছবি: লেখক
নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাড়িতে মশা। ছবি: লেখক

বর্তমান মহাদুর্যোগের কালে করোনা ছাড়া অন্য খবরে কারও আগ্রহ থাকার কথা নয়। তাই আমার এ লেখা কারও দৃষ্টিতে পড়বে কি না বা দৃষ্টিতে পড়লেও কেউ পড়ে দেখবেন কি না, তাতে কিছুটা সংশয় আছে বৈকি। কিন্তু আমার কাছে যে করোনা ও মশা—দুটোই বিরাট ভয়ের নাম। কারণ, করোনা কামড় বসাক আর না-ই বসাক, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক মশা কিন্তু কামড় বসিয়েই যাচ্ছে।

এককথায়, মশার উৎপাতে করোনার আগমনের আগেই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে মনে হয়। তাই আমার মতো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের সাধারণ নাগরিকদের কাছে করোনার পাশাপাশি আরেক বড় ভয়ের নাম, ঘাতকের নাম ‘মশা’।


করোনা আঘাত হানার পর এর যন্ত্রণা শুরু হয়, কিন্তু ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া আক্রমণ করার বহু আগে থেকেই তাদের দূত মশারা জীবন ঝালাপালা করার যজ্ঞ চালাতে থাকে। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া হানা দিক আর না দিক, দিনের পর দিন ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াকে স্বাগত জানানোর সৈনিক মশাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত অত্যাচারে নগরের মানুষের আরাম-আয়েশ ও জীবন—দুটোই প্রায় যায় যায়! তাই করোনার পাশাপাশি অনেকের মতো আমাকেও এই মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে।


একটু আলোর কমতি পড়তেই মশার ভোজনবিলাস শুরু হয়ে যায়। তাই মশার হুল ফোটানো থেকে বাঁচতে প্রতিদিন আসরের পরপরই বাসায় মশারি টাঙাতে হয়। মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ, ইফতার, রাতের খাবার ও সাহ্‌রি খেতে হয় মশারির ভেতরেই। কখনো কখনো মেঘলা দিনগুলোতে এই টাঙানো মশারি কয়েক দিন আর খোলা হয় না। এ যেন কোয়ারেন্টিনের ভেতর আরেক কোয়ারেন্টিন! সাধারণ ছুটির গত প্রায় দেড়টি মাস এভাবেই নির্যাতিত বন্দীর মতো কাটছে আমার ও আমার পরিবারের।


আমি গত দেড় মাসে দেড় মিনিটও টেলিভিশন দেখিনি। কারণ, টেলিভিশন দেখা, খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, বিশ্রাম, টয়লেট—সবকিছুতেই যে বিধিবাম এই মশা। কি দিন কি রাত, মশার হুলের বিষে একেবারে জীবন অসহ্য! আপনি পাঁচ মিনিট কোথাও বসলে কয়েকটি মশা আপনার গায়ে বসে রক্তপিপাসা পূরণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে। অসহ্য ব্যথা আর চুলকানিতে অস্থির থাকতে হয় সারাক্ষণ।


রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমরা স্বামী-স্ত্রী মশারির ভেতরে মশা খোঁজে বের করার ও মারার চোর-পুলিশ খেলায় মেতে উঠি। টানা আধা ঘণ্টা অভিযান চালানোর পর ভাবি, সব মশা বোধ হয় মারা হয়ে গেছে। এরই মধ্যে এক বছর বয়সী আমার একমাত্র মেয়েটিও তার মায়ের কোলে আস্তে আস্তে ঘুমের রাজ্য পানে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ করেই মেয়েটি আমার গোঙানি দিয়ে কেঁদে ওঠে, দুই হাতের কচি নখগুলো দিয়ে সজোরে শরীরের এখানে-ওখানে এলোপাতাড়ি চুলকাতে থাকে। বুঝতে আর বাকি থাকে না মশারা সব মরেনি; আর বেঁচে যাওয়া এ পতঙ্গগুলোই আমার মেয়ের শান্তির ঘুমে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আবার মশা মারার ব্যাট নিয়ে মশারির চারপাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মশা খুঁজতে শুরু করি। আমাদের এই কসরত চলমান থাকাবস্থায় আমার মেয়েটির আবার ঘুমের রাজ্যে পুনর্যাত্রা হয়।


একপর্যায়ে মশা মারার কসরত শেষে আমরাও ঘুমাতে যাই। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ করেই জ্বালাময় চুলকানি অনুভব করি হাতের আঙুল, বাহু বা পায়ের পাতায়। ঘুম ভাঙলে বুঝতে পারি, ঘুমের ঘোরে শরীর মশারির সঙ্গে লেগে যাওয়াতে মশার ঝাঁক একসঙ্গে এতক্ষণ আমাকে সাবাড় করেছে। সারা দিন, সারা রাত মশারি টাঙিয়ে রাখার শোধ নিয়েছে। রাতের বেলা কোনো কারণে মশারি থেকে বের হলে স্রোতের গতিতে মশা ছুটে আসে রক্তপিপাসা মেটাতে। আমার শোবার রুমে এক রাতে ফ্যানের ঝাপটায় মরে পড়া এক ঝাঁক মশার কয়েকটি ছবি পাঠিয়েছি। এ ছবিগুলো দেখলে পাঠকেরা বুঝতে পারবেন আমাদের রুমে অক্সিজেন নাকি মশার আধিক্য বেশি!

মশার কামড়ে অতিষ্ঠ সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকার মানুষ। ছবি: লেখক
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকার মানুষ। ছবি: লেখক

কিন্তু এরপরও নিজের জন্য কোনো কষ্ট নেই, কোনো অভিযোগও নেই। কষ্ট শুধু অবুঝ, বলতে না পারা নিষ্পাপ মেয়েটার জন্য! তার শরীরে মশার কামড়ের জায়গাগুলো ফুলে চাকা চাকা হয়ে যায়। প্রতিটি রাতে অনেক অস্বস্তি নিয়ে শেষ পর্যন্ত অবুঝ মেয়েটি আমার ঘুমালেও ঘুমের মধ্যেও শরীরের ফুলে যাওয়া অংশে সজোরে চুলকাতে থাকে। নখের আঁচড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। আর এটা এক দিনের ঘটনা নয়। দিনের পর দিন এভাবে রক্তাক্ত হতে হতে আমার নিষ্পাপ মেয়েটির ফুটফুটে শরীরটা কালো দাগ আর ক্ষতে ছেয়ে গেছে। আমি বাবা হয়ে আমার মেয়ের এ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না। কিন্তু এই দেশ তো মা, আমার মা, আমার মেয়েরও মা। তাহলে এই দেশ কী করে সহ্য করছে দিনের পর দিন আমার মেয়ের ওপর এ অত্যাচার? আমার নিষ্পাপ মেয়েটির প্রতিটি যন্ত্রণাপূর্ণ দিন আর নির্ঘুম রাতের দায় কার, আমার, না রাষ্ট্রের?


বাবা হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মশার উপদ্রব থেকে আমার সন্তান ও পরিবারকে বাঁচাতে আমি কী করতে পারি? অসহ্য গরমে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখার কোনো উপায় নেই। মশারি, অ্যারোসল, কয়েল, ধূপের ধোঁয়া, ব্যাট ব্যবহারের মাধ্যমে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত নেই আমার। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এসব পদ্ধতির কোনোটিতেই মশার কিচ্ছুটি করা যাচ্ছে না। দেশীয় ও বিদেশি কোনো অ্যারোসলই মশা পরোয়া করে না। নিরুপায় হয়ে মনকে সান্ত্বনা দিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কিছুটা সময় ব্যবহার করি কয়েল। কিন্তু যে কয়েল মশা তাড়াবে, সেই ধোঁয়া ওড়া কয়েলের গায়েই মশা বসে থাকে। ধূপের ধোঁয়ায়ও কিছু হয় না। মশা মারার ব্যাট দিয়ে গুনে গুনে কয়টি মশা আর মারা যায়! এত প্রটেকশন নেওয়ার পরও মশার উপদ্রবে আমার পরিবার এবং এই এলাকার বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।


আমার বাসা সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ভিআইপি এলাকা না হলেও সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকাটি আংশিক নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত আর আংশিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত। তবে আমার বাসাটি নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি লাঘবে দুই সিটি করপোরেশনের কারোরই কোনো জনহিতৈষী কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা আর কলকারখানা ও মানববর্জ্যে নোংরা ও বিষাক্ত হয়ে ওঠা পার্শ্ববর্তী খাল দুটোই মূলত মশার মূল অভয়ারণ্য। কিন্তু খাল দুটো রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ দেখি না। তা ছাড়া মশা মারতে ফগার মেশিন দিয়ে বছরে যে দুই-তিন দিন মশার ওষুধ ছিটানোর মহড়া দেওয়া হয়, এতে বাসাবাড়ির মশা মরেও না, সরেও না; বরং আশপাশের খাল ও নর্দমায় থাকা মশাগুলোও বাসাবাড়িতে ঢুকে অবস্থান নেয়।


এভাবে অনাদরে-অবহেলায় পড়ে থাকা এই এলাকার বাসিন্দাদের তাই দিনের বেলা কোনোরকম কেটে গেলেও রাতের অন্ধকার নামতেই তাদের জীবনে নেমে আসে মশার জীবন অতিষ্ঠ করা উৎপাত। রাতের বেলায় বাসার বাইরে গেলে বৃষ্টির মতো মশার ঝাপটা ঠেলে ঠেলে রাস্তা চলতে হয়, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু কিনতে চাইলে মৌচাকে বসা মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।


এই এলাকায় শুধু আমার অবস্থাই যে বেগতিক, এমনটা নয়। এই স্থানের বাসিন্দাদের প্রায় সবারই ইট-পাথরে গড়া আলিশান বাড়ি আছে, ফ্রিজভর্তি খাদ্যের জোগান আছে, অনেকেরই আছে ব্যাংকভর্তি টাকাও; শুধু জীবনে স্বস্তি নেই। এই এলাকায় থাকতে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহও নেই আমার। প্রায় প্রতিদিনই এই এলাকা ছাড়ার ইচ্ছা হয়। কিন্তু কোথায় যাব? যেখানে যাব, সেখানে যে এর চেয়েও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে। তা ছাড়া আমার মতো অর্থনৈতিক জাঁতাকলে পিষ্ট ভাড়াটেরা চাইলেই তো আর গুলশান-বনানীতে উঠে যেতে পারে না। তাই দিনের পর দিন মুখ বুজে সীমাহীন যাতনা সয়েই যাচ্ছি।


জানি না এই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমার মেয়ের, আমার পরিবারের এবং এই এলাকার বাসিন্দাদের নিদারুণ কষ্টগুলো আমলে নেবে কি না। কারণ, কয়েক দিন আগেই ফেসবুকে এক অডিওতে এই সিটি করপোরেশনের এক বাসিন্দাকে মেয়রের কাছে ত্রাণ চেয়ে কড়া ধমক খেতে শুনেছি। তাই আমাকেও না জানি আবার কোন ধমক খেতে হয়! কিন্তু আমি দাওয়াত দিচ্ছি, সিটি করপোরেশনের মেয়র না হোক, দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ দয়া করে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আমার বাসায় এসে ডাইনিংয়ে বসে রমজানের রাতের এক বেলা সাহ্‌রি খেয়ে যান! তাহলে হয়তো এই এলাকার নাগরিকদের জীবনযন্ত্রণাটা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন।


*লেখক: ব্যবস্থাপক, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড, পাকুন্দিয়া শাখা, কিশোরগঞ্জ। সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড এলাকার একজন বাসিন্দা। [email protected]