‘আমার আপন বলতে আর কেউ থাকল না’
‘আমার ঘরে বাতি জ্বালানোর মতো কেউ রইল না। দুই ছেলে, স্ত্রী সবাই একা ফালাইয়া চইলা গেল। আমার সব শেষে হয়ে গেল। এই দুনিয়াতে আমার আপন বলতে আর কেউ থাকল না।’
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার নতুনগাঁও কেন্দ্রীয় শ্মশানে স্ত্রী সুনীতা সাহার (৪০) লাশ দাহ করতে এসে আহাজারি করছিলেন সাধন সাহা (৫০)।
শীতলক্ষ্যায় লঞ্চডুবিতে অপেক্ষার পর রাত সাড়ে ৩টার দিকে স্ত্রীর লাশ বুঝে পেয়েছেন। তবে তাঁর দুই সন্তান আকাশ সাহা (১২) ও বিকাশ সাহা (২২)এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।
সাধন সাহা বলেন, স্ত্রী সুনীতা সাহা রোববার সকালে দুই ছেলে বিকাশ সাহা (২২) ও আকাশ সাহাকে (১২) নিয়ে ঢাকা জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট হাসপাতালে গিয়েছিল।
সেখানে আকাশের চোখের চিকিৎসা হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে শেষবার ফোনে জানিয়েছিল, সাবিত আল হাসান লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাট হয়ে মুন্সিগঞ্জ ফিরছে তিনজন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে টিভিতে দেখলাম লঞ্চ ডুবেছে। এরপর থেকে স্ত্রী-সন্তানের মোবাইল বন্ধ। রাতে স্ত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। শেষ বিদায় দিতে এসেছি।
সাধন আরও বলেন, জীবিত না হোক অন্তত দুই ছেলের লাশ হলেও চান তিনি। একদিকে নিহত স্ত্রী সুনিতা সাহার লাশ পোড়াচ্ছেন, অন্যদিকে নিখোঁজ আর কোনো লাশ উদ্ধার হলো কি না, ফোনে সেই খবর নিচ্ছেন।
আজ বেলা ২টার দিকে সাধন জানালেন, শুনেছেন আরও অনেক লাশ উদ্ধার হয়েছে। তিনি তাঁর স্বজনদের সেখানে পাঠিয়েছেন।
নিহত সুনিতা সাহার বড় বোন মণি সাহা শ্মশানের মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ করতে করতেই বলছিলেন, ‘আমার বোনটা লঞ্চে উঠতে চাইত না। সব সময় বলত, লঞ্চে উঠলে সেটা ডুবে যাবে। লঞ্চ ডুবে মারা যাবে। খুব ভয় পেত। লঞ্চে চড়লেও কখনো নিচে বসতে চাইত না। ছেলেদের আবদারে লঞ্চে করেই মুন্সিগঞ্জের দিকে আসছিল। বোন আমার জীবিত আর ফেরত আসল না। আমরা আমার বোনের লাশটি পেয়েছি।’
মুক্তারপুর নৌ পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ পরিদর্শক কবির হোসেন সোমবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে প্রথম আলোকে জানান, গতকাল রাতেই পাঁচটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর আর কাউকে উদ্ধার করা যায়নি। লাশ উদ্ধারের কাজ বন্ধ আছে। বিআইডব্লিউটিএর লোকজন হেলাফেলায় দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এ সময় তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘এমন ছোট একটি লঞ্চ আমাদের দিলে আমরা সেটা ট্রলার ও চেইনের সাহায্যেই উদ্ধার করে ফেলতাম। স্বজনদের আহাজারিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’
গত বছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ৩০ জন মারা যান। গত রোববার রাতে শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৪ জনের লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। আরও ৯ জন নিখোঁজ আছেন বলে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।