-আপনে তো চারবার আইলেন আবার ক্যান?
-ভাই আসছি, গণতন্ত্র রক্ষা করতে, একটু সুযোগ দেন।
-রাখেন আপনার গণতন্ত্র, ওই দেখেন সাংবাদিকেরা দাঁড়িয়ে আছেন।
জাল ভোট দিতে আসা এক যুবকের সঙ্গে এভাবেই কথা বলছিলেন গুলশান মডেল স্কুল ও কলেজ কেন্দ্রের পোলিং অফিসার আমজাদ হোসেন। ভোট দেওয়া থেকে তিনি কোনোভাবেই যুবককে বিরত করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রথম আলো প্রতিনিধিকে দেখিয়ে তাঁকে নিবৃত করেন।
গুলশান-২ নম্বরে ৮৬ নম্বর সড়কে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। দুটি তিনতলা ভবনে মোট পাঁচটি ভোটকেন্দ্র। ভোটারসংখ্যা ১১ হাজার ৬৮৯। এটি নির্বাচনী এলাকায় ঢাকা-১৭-এর মধ্যে পড়েছে। এ আসনে তিন প্রার্থী হলেন টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) প্রেসিডেন্ট এস এম আবুল কালাম আজাদ, সাইকেল প্রতীকে জেপি প্রার্থী আবদুল লতিফ মল্লিক এবং ফুটবল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ হান্নান মৃধা।
বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা গেল পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে আটটি। সব বুথ ফাঁকা। কিন্তু স্কুল মাঠের ভেতরে জনা পঞ্চাশেক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। বাদামি জ্যাকেট পরা এক ব্যক্তি তাঁদের নেতা। জানা গেল, তাঁর নাম আখতার হোসেন। তিনি উত্তর যুবলীগের নেতা। তাঁর সঙ্গে আছেন হূদয় নামের আরেক ব্যক্তি। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এসব লোক কোনো অনুমতির ধার ধারছেন না। তাঁরা যখন-তখন বুথে ঢুকেছেন আর বের হচ্ছেন। পরিচয় প্রকাশ না করে মাঠের জটলা থেকেই শোনা গেল, তাঁদের কথাবার্তা। কেউ একজন বলছেন, ‘১০০ করে ভোট ১২ হাজার। পারবি না? যা তাড়াতাড়ি কর। লম্বা করে সবাই লাইনে দাঁড়াও। কেউ কিছু বুঝবে না। শুধু একজন একজন করে ভোট দিয়ে আস।’ আরেকজন বলছেন, ‘কী করে যাব, সাংবাদিক আছে তো।’ এরপর মাঠের ভেতরে দায়িত্বরত এক টিভি সাংবাদিককে ডেকে এক যুবক বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘বড় ভাই দয়া করে একটু বাইরে যান, একটা ঘণ্টা সময় আমাদের দেন। কিছু একটা করি। মানসম্মান তো থাকছে না।’ যুবকদের কথায় টিভি সাংবাদিক কেন্দ্রের বাইরে চলে যান। এরপর যুবকদের একজন নিচের তলার কেন্দ্রে ঢুকে সিল মারতে শুরু করেন প্রকাশ্যে। প্রথম আলোর ক্যামেরায় তা ধরাও পড়ে। কিছুক্ষণ পর বুথে ঢোকেন আরেকজন যুবক। তিনিও সিল মারতে শুরু করেন। কিন্তু এ খবর দ্রুত রটে যায়। ঘটনাস্থলের অল্প দূরেই খালেদা জিয়ার বাসভবন। আগে থেকেই সেখানে একদল সংবাদকর্মী অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে কয়েকজন দ্রুত এসে হাজির হন। এরপর সব ভেস্তে যায়। যুবকেরা সরে গিয়ে মাঠের মধ্যে অবস্থান নেন। তবুও দিনভর নানা চেষ্টা চলতে থাকে। গণমাধ্যম কর্মীরাও সহজে মাঠ ছাড়ছিলেন না। বেলা আড়াইটার দিকে ৬০ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুস সালামকে কয়েকজন যুবক এসে বলেন, ‘আমাদের লোকজন আসবে ভোট দিতে, তাঁরা যেকোনো কাগজই নিয়ে আসুক ভোট যেন দিতে পারে। এ প্রতিবেদকের সামনেই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তাঁদের বলেন, ‘ভাই মাফ করেন, আমি এটা করতে পারব না।’
বিকেল তিনটা ৫০ মিনিটে ৬০ নম্বর কেন্দ্রের ২ নম্বর বুথে তড়িঘড়ি করে ভোট দিচ্ছিলেন আবদুল মান্নান। তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, তিনি এ বুথের পোলিং অফিসার। ভোট শেষ হওয়ার আগে নিজের ভোটটি দিলেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, আবদুস সাত্তার নামে অন্য এক লোকের ভোটটি তিনি দিয়েছেন। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ভর রঞ্জন চক্রবর্তীর কাছে এ অভিযোগ করলে তিনি নীরব থাকেন।
কিন্তু এত কিছুর পরও ভোট শেষে দেখা গেল পাঁচ কেন্দ্রে ১১ হাজার ৬৮৯ ভোটের মধ্যে পড়েছে মাত্র ৩৭৬টি। অর্থাৎ তিন শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটের এ সংখ্যা শুনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পোলিং অফিসার বলেন, ‘ভাই যশোরের এমপি আফিল উদ্দিন যে ফর্মুলা দিয়েছিলেন সেভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সাংবাদিকেরা এসে পড়ায় কাজ হয়নি।’
যশোরের সাংসদ শেখ আফিল উদ্দীন যশোরে নির্বাচনী সভায় বলেছিলেন, ‘১০০ ছেলে থাকবে প্রতিটি কেন্দ্রে। ওরা বুথে যাবে, আবার এসে লাইনের পেছনে দাঁড়াবে। ওরা বাড়ি যাবে না। ১০০ ছেলে সব সময় লাইনে থাকবে। এইভাবে বুথে যাবে, আবার আসবে। লোক ও সাংবাদিকেরা এসে দেখবে যে ভোটের মাঠ ভরা।’