আনিসুজ্জামান তাঁর জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে গত বছরের ১৪ মে চলে গেলেন। শারীরিকভাবে গত হয়ে যাওয়ার পর আজ তাঁর প্রথম জন্মদিন। তিনি বেঁচে ছিলেন এক বিপুল জীবনে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘটনাবহুল ইতিহাসের কালপর্বে। এই ইতিহাস তাঁর জীবনের ওপর দিয়ে কেবল বয়েই যায়নি, তাঁর জীবনে অমোচনীয় দাগও কেটে গেছে। এই ইতিহাসের তিনি নিতান্ত দর্শক ছিলেন না। সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নিয়েছেন। নিজের মতো করে একে বোঝার এবং ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ভাষা ও চিন্তায় হাজির করা এবং বাঙালির ঘূর্ণাবর্ত্মময় ইতিহাসে অংশগ্রহণ করা, এককথায় এটিই আনিসুজ্জামানের সারা জীবনের সারমর্ম।
এই জন্মদিনের ঠিক আগে আগে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হলো আনিসুজ্জামানের তিনটি বই—আমার অভিধান, মহামানবের সাগরতীরে: ইতিহাস সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি, স্মৃতির মানুষ। বই তিনটি যেন আনিসুজ্জামানের জীবনের সেই সারসত্যই আবার নতুন করে তুলে ধরেছে। আমার অভিধান আনিসুজ্জামানের নিজের পরিকল্পিত শেষ বই; বাংলা ভাষার নানা শব্দের ব্যঞ্জনা নিয়ে জীবনব্যাপী মগ্ন এই অধ্যাপকের ব্যক্তিগত অনুভূতিমালা। বাকি বই দুটো প্রথমা প্রকাশনেরই পরিকল্পিত। মহামানবের সাগরতীরে আর স্মৃতির মানুষ বই দুটো প্রথম আলো আর ভোরের কাগজ–এ বেরোনো আনিসুজ্জামানের দুই ধরনের লেখার বাছাই সংকলন। তাঁর প্রতি প্রথম আলোর শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রথমটি মূলতই বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজ–সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর ভাবনা। আর যে মানুষেরা বাঙালি সমাজের বিকাশে কোথাও না কোথাও ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের পর্যালোচনা আর সান্নিধ্যস্মৃতি দ্বিতীয় বইটির বিষয়।
মর্মমূলে বাংলাদেশ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আনিসুজ্জামান উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। তরুণ সেই বয়সেই তিনি জড়িয়ে পড়েন সে আন্দোলনে। ভাষার দাবির প্রবল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের বাঙালি তাঁদের নতুন ইতিহাস রচনার স্বপ্নের সূচনা করে। ইতিহাসের প্রবল টানে সেই যে বাঁধা পড়লেন আনিসুজ্জামান, তার থেকে আর মুক্ত হননি। মুক্তি তিনি চানওনি। ভাষার আন্দোলন তাঁর মধ্যে যে কর্মিসত্তার উদ্বোধন ঘটাল, সেটি সচল রইল আজীবন। এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন মুহুর্মুহু।
জাতির নতুন তৃষ্ণা আনিসুজ্জামানের গবেষকসত্তার মধ্যেও জেগে উঠল। পূর্ববঙ্গের বাঙালি তখন নতুন যে জাতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, তাঁর গবেষণা যেন হয়ে উঠল তারই নানা উপাদানের অনুসন্ধান। সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর লেখালেখি সাহিত্যকে ছাপিয়ে গেল। সাহিত্যের প্রবেশতোরণ দিয়ে ঢুকে তিনি এসে দাঁড়ালেন সমাজ-ইতিহাসের প্রসারিত আঙিনায়।
বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জন্য গবেষণার চেয়ে সময়ের উৎকণ্ঠাকাতর প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার তাগিদ তিনি অনুভব করেছেন বেশি। সে জন্য রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাসে তৃষ্ণার্ত পর্যটকের মতো ছুটে বেরিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আন্দোলনের উপর্যুপরি তরঙ্গমালা আনিসুজ্জামানের কর্মিসত্তা ও গবেষকসত্তাকে কেবল প্রসারিতই করেনি, তাঁর এই দুই সত্তা একে অপরকে ভেদ করেছিল। এই চর্চার মধ্য দিয়ে যেগুলোকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলে উপলব্ধি করেছিলেন, সেসবের মর্মবস্তু উপস্থাপন এবং সুরক্ষা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের পরে তাঁর লেখালেখির প্রিয় বিষয়।
মহামানবের সাগরতীরে: ইতিহাস সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি, স্মৃতির মানুষ বইটি আনিসুজ্জামানের সেই মনেরই প্রতিফলন। এ বইয়ের লেখাগুলো চারটি পর্বে বিন্যস্ত—‘ইতিহাস ও রাজনীতি’, ‘সমাজ ও সংস্কৃতি’, ‘শিল্পসাহিত্য’ ও ‘স্মৃতি’। প্রথম পর্বের সব রচনার বিষয়বস্তুর মূলে বাংলাদেশের ইতিহাস—একুশে থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্যালোচনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দীন আহমদের মতো এ ইতিহাসের অগ্রনায়কেরা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। দ্বিতীয় পর্বের বিষয় বাংলাদেশের সমাজকে ঘিরে তাঁর নানা আকাঙ্ক্ষা—অসাম্প্রদায়িকতার জাগরণ, অবাধ বাক্স্বাধীনতা, মানুষ গড়ার শিক্ষা, নারীর মুক্তি ইত্যাদি। তৃতীয় পর্বে বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। চতুর্থ পর্ব তাঁর তিনটি স্মৃতিখণ্ড—পটভূমি সেই একই—একুশে আর মুক্তিযুদ্ধ; আরেকটি এসবের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত তাঁর জীবনস্রোত। শিরোনাম অসাধারণ, ‘জীবনে আমার কোনো খেদ নেই’।
জীবন ও জগৎকে দেখার চোখ তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, শেষ এই স্মৃতিকথাটিতে আছে তার অন্তরঙ্গ স্বীকৃতি: ‘ভাষা–আন্দোলনের অল্পকাল পরে আমি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি। সে সংযোগ বছর পাঁচেকের বেশি স্থায়ী হয়নি। তবে ওই সময়ে বামপন্থার যে শিক্ষা লাভ করেছিলাম, তা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালের জন্য গঠন করে দিয়েছিল।’
ইতিহাসের মানুষেরা
অধ্যাপনা, গবেষণা আর সামাজিক দায়—অতি তরুণ বয়স থেকেই আনিসুজ্জামানের জীবন এই তিন ধারায় বইতে শুরু করে। এই তিন জগতের বিচিত্র মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। তাঁদের জগৎ বিচিত্র, বয়স বিভিন্ন, ব্যক্তিত্বের ধাঁচ স্বতন্ত্র। সবচেয়ে বড় কথা, আদর্শে আর দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে তাঁদের অনেকেরই মন আনিসুজ্জামানের চেয়ে আলাদা, কারও কারওটা যথেষ্ট দূরের। কিন্তু তিনি তাঁদের নিয়ে অকাতরে অজস্র ধারায় লিখেছেন।
স্মৃতির মানুষ বইটি কৃতী ব্যক্তিদের নিয়ে আনিসুজ্জামানের পর্যালোচনার সমাহার। সত্যি বলতে কি, নানা বর্ণ ও মাত্রার ব্যক্তিদের নিয়ে
এত লেখা তাঁর মতো আর কেউ লিখেছেন কি না সন্দেহ। যাঁদের নিয়ে মূল্যায়নধর্মী লেখা এ বইয়ে মলাটবদ্ধ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন সরদার ফজলুল করিম, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মুনীর চৌধুরী, মণি সিংহ, খান সারওয়ার মুরশিদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আলতাফ মাহমুদ, শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ।
এই ব্যক্তিদের নিয়ে লেখার মধ্যেও দেখা যাবে ইতিহাসের প্রতি আনিসুজ্জামানের সেই একই দায়বোধ। এঁদের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন বাংলাদেশের সমাজের উজ্জ্বল কোনো উত্থানরেখা। সে কারণে তাঁর এসব লেখার অনেকগুলোতেই ব্যক্তিকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে সমাজ বা মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকে নিয়েই কোনো প্রসারের চিহ্ন।
ব্যক্তিগত ভাষাকোষ
আনিসুজ্জামানের মূল ঝোঁক ছিল সাহিত্যের ভেতর দিয়ে সমাজকে দেখার চেষ্টা। কেবলই ভাষা নিয়ে কখনো তাঁকে তেমন মগ্ন হতে দেখা যায়নি। দুয়েকবার অভিধান প্রণয়নে হাত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এটা আমার কাজ নয়।’ কিন্তু দায়িত্ব পালনে বিমুখ হননি। একবার আইন-শব্দকোষ নামে অতিকায় এক অভিধান রচনা করেছিলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যৌথভাবে। আরেকবার ১৭৮৫ সালে ওগুস্তেঁ ওসাঁ রচিত বাংলা-ফরাসি শব্দকোষ সম্পাদনা করেছিলেন ফ্রাঁস ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে। শেষ জীবনে সেই আনিসুজ্জামানই লিখতে বসলেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অভিধান।
আমার অভিধান আনিসুজ্জামানের সর্বশেষ পরিকল্পিত কিন্তু অসমাপ্ত বই।
এ বইয়ের বিষয় কেবলই ভাষা—বাংলা শব্দের শুদ্ধ ও সংযত ব্যবহার—আর কিছু নয়। অর্থে, ব্যঞ্জনায়, বানানে, প্রয়োগে যেসব শব্দ নিজেদের প্রকৃত জায়গা থেকে সরে এসেছে, সহজভাবে সেই বিচ্যুতিটুকু ধরিয়ে দেওয়া। অল্প দু–চার লাইনে, অনেক সময়ই কোমল কৌতুকময় আভাসে।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘ধূম্র’ শব্দটি নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ধূমল বা ধোঁয়া রঙের (“কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়”)। অনেক সময়েই ভুল করে ধোঁয়া অর্থে ব্যবহার করা হয় (ধূমপানের বদলে ধূম্রপান কিংবা ধূমজালের জায়গায় ধূম্রজাল)। একটু সতর্ক থাকলেই ভুলটা এড়ানো যায়।’
প্রথমে এ রকম মোট এক শ শব্দ নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল আনিসুজ্জামানের। আরও পরে কমিয়ে ভেবেছিলেন ৮০টি শব্দ লিখবেন। ৬২টি শব্দের পরে আর পারেননি। আমার অভিধান নিয়ে তাঁর ভাবনার বাস্তবায়ন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। তারপরও এটি তারই পরিকল্পিত শেষ বই। এর মধ্যে রয়ে গেল ভাষা নিয়ে বাংলার প্রখর এই অধ্যাপকের একান্ত মনের প্রতিফলন।
এই কর্মী অধ্যাপকের বিপুল পৃথিবীকে এই বই তিনটি নতুন করে আমাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এল।