আনন্দনগরের রূপ নিল ঢাকা
হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে। প্রবল স্রোতে যেমন ভেসে যায় খড়কুটো, তেমনি বয়স, শ্রেণী, পেশা, ধর্মের পরিচয় ভেসে গেছে জনস্রোতে। আকাশে জ্বলছে সূর্য। গনগনে উত্তাপ রোদের। কেউ উঁচিয়ে তুলেছেন সরু কাঠির মাথায় আটকানো শক্ত কাগজে ছাপা লাল-সবুজ পতাকা। কেউ মাথার ওপর তুলে ধরেছেন ছাতা। কারও হাতে তালপাতার পাখা, নারিকেলমালার একতারা। কচি-কাঁচারা শক্ত মুঠোয় ধরে আছে গ্যাসভরা রঙিন বেলুনের সুতা। আর অধিকাংশের হাতেই প্লাস্টিকের বাঁশি। ফুঁ দিচ্ছেন মনের সুখে। সেই বাঁশির পোঁ-পোঁ আওয়াজে সচকিত চারদিক। এই পথচলাই যেন বাংলা নববর্ষের প্রধান আনন্দ হয়ে এসেছিল গত সোমবার নগরবাসীর জীবনে। ঢাকা পরিণত হয়েছিল আনন্দনগরে।
খুব ভোরেই শুরু হয়েছিল ঘরছাড়ার পালা, যেমন হয়ে থাকে প্রতিবছর। রাজধানীতে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের আয়োজন ইদানীং ছড়িয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। তার পরও রমনা, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রধান কেন্দ্রটির প্রতি আগ্রহ কমেনি। বেশির ভাগ মানুষের গন্তব্যই ছিল এই এলাকা। ফলে বিশাল এই এলাকা পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। বরাবরের মতোই সকাল ছয়টা ১৫ মিনিটে রমনার বটমূলে শুরু হয়েছিল ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী প্রভাতি গানের আসর। তার আগেই রমনা প্রায় ভরে উঠেছিল জনসমাগমে।
এবার নিরাপত্তাব্যবস্থাতেও ছিল যথেষ্ট কড়াকড়ি। সকাল আটটা নাগাদ পথ, উদ্যান, প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছিল উৎসবে শামিল। লোকে লোকাকার। লাল-সাদা তাঁতের শাড়ি, মাথায়, খোঁপায় ফুলের মালা, হাতে রেশমি কাচের চুড়ি ছিল নারীদের সাজ। পুরুষের রঙিন পাঞ্জাবি। রংতুলি হাতে পথে পথে রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত আঁকিয়ের দল। তাদের দিকে চিবুক কিংবা বাহু বাড়িয়ে দেওয়া মাত্র রঙিন হয়ে উঠছে রঙে-নকশায়। আর অনেকেই মাথায় জড়িয়ে নিয়েছেন পতাকার ছাপ দেওয়া রাবার ব্যান্ড কিংবা নতুন গামছা। বাড়ি থেকে যাঁরা মাথায় গামছা বেঁধে আসেননি, তাঁদেরও কোনো অসুবিধা ছিল না। গামছার পসরা ছিল ফুটপাতেই। কিনে মাথায় জড়াতে দেখা গেছে অনেককেই।
বাংলা বছরের প্রথম দিনে রাজধানীতে নাগরিক আধুনিকতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল আবহমানকালের লোকসংস্কৃতি। চলবে-বলনে, পোশাক-আশাকে, খানাপিনায়, গানবাজনায়, কেনাকাটায় ষোলোআনা বাঙালি হওয়ার এক স্বপ্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়েছিল রাজধানীতে। বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-কুলা থেকে শুরু করে বঁটি-খন্তা, বাঁশের বাঁশি, ঢোল, ডুগডুগি, টমটমি গাড়ি, খাজা-গজা অবধি গ্রামীণ মেলার যাবতীয় উপকরণ হাজির শহরের ফুটপাতে। গরমে গলা শুকিয়ে এলে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য ছিল ডাব আর লেবু-পানি। আরও ছিল তরমুজের ফালি, শসা, পেয়ারা, আনারস আর কাসুন্দি মাখা কাঁচা আম। রসনা তৃপ্তি হয়েছে তাতে।
বৈশাখী উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়েছিল সকাল নয়টায়। এবার শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘জাগ্রত করো, উদ্যত করো, নির্ভয় করো হে’। ঢাকঢোলের বাদ্য, বাঁশির আওয়াজ, অসংখ্য মানুষের হর্ষধ্বনিতে পরিবেশ মুখর করে অসংখ্য মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রায় ছিল বিশালাকার মাছ, টেপা-পুতুল, প্যাঁচা, বাঘ আর হরেক রকমের মুখশ্রী নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাটি অনুষদের সামনে থেকে যাত্রা শুরু করে শাহবাগ চত্বর ঘুরে আসে।
দিনের অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে সকালে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর গান ছিল শিশুপার্কের সামনে নারিকেলবীথি চত্বরে। সুরের ধারার আয়োজনে সহস্রকণ্ঠে গানের অনুষ্ঠান ছিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে। সাতমসজিদ রোড থেকে ইউডার চারুকলা বিভাগ ও পুরান ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ দুটি পৃথক মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ধানমন্ডি ক্লাবের আয়োজনে সকাল ছয়টা থেকেই গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে। বিকেলে এখানে ছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে দলীয় সংগীতে ছিল ক্রান্তি, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, বহ্নিশিখা, স্বভূমি। নৃত্য পরিবেশনায় ছিল নৃত্যশ্রী। এ ছাড়া ছিল বিশিষ্ট শিল্পীদের একক সংগীত ও আবৃত্তি।
লেকের পাশ দিয়ে সারা দিনই বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সকাল আটটায় ১২ নম্বর সড়কসংলগ্ন লেকের পাশে অনুষ্ঠান করে সারগাম ললিতকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমী তাদের প্রাঙ্গণে বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সন্ধ্যায়। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বৈশাখের অনুষ্ঠান চৈত্রসংক্রান্তির রাত থেকেই শুরু হয়েছিল বেঙ্গল গ্যালারিতে।