২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আঙুল কেটে খুনিরা নিশ্চিত হয় পুলিশ কর্মকর্তা মৃত

মামুন ইমরান খান
মামুন ইমরান খান

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১০ জন। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। আলোচিত এই খুনের মামলায় ৮ এপ্রিল ১০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান। গতকাল বুধবার রাতে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন ১০ জন। লোকজনকে ভয় দেখিয়ে (ব্ল্যাকমেল) অর্থ আদায় করত চক্রটি।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, রহমত উল্লাহর সঙ্গে অভিনয়ের সূত্র ধরেই পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানের পরিচয়। এরপর বন্ধুত্ব। টেলিভিশনে দুজন ক্রাইম ফিকশন অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন। এই দুজনের সঙ্গে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী অভিনয় করত। ওই কিশোরী রহমত উল্লাহকে জন্মদিনের দাওয়াত দেয়। রহমত উল্লাহ তখন মামুনকেও ওই অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানান। বনানীর ওই বাসার নিচে আসেন মামুন ও রহমত উল্লাহ। তখন ওই কিশোরী বাসার নিচে এসে দুজনকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে তাঁরা দেখেন, জন্মদিনের কোনো আয়োজনই নেই। মামুন ও রহমত উল্লাহকে খুনিরা বলেন, ‘তোরা কারা, এখানে কেন এসেছিস?’

তখন মামুন পুলিশ পরিচয় দিলে খুনিরা তাঁর ঘাড়ে আঘাত করেন। হাত-পা বেঁধে ফেলেন। রাত ১২টার দিকে খুনিরা বুঝতে পারেন, মামুন মারা গেছেন।

অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ আসামি হলেন রবিউল ইসলাম (৩০), রবিউলের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া (২১), রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দিদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১), সারোয়ার হোসেন (২৩) এবং দুই কিশোরী (দুজনের বয়স ১৬ বছর)।

গত বছরের ৯ জুলাই গাজীপুরের জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় খুনের মামলা করেন।

যেভাবে খুন
বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করা এই চক্রের প্রধান হলেন আসামি রবিউল ইসলাম। অভিযোগপত্রে বলা হয়, অভিনয়ের সূত্রধরে রহমত উল্লাহর পরিচিত কিশোরীর সঙ্গে ফেসবুকে তাঁর যোগাযোগও ছিল। ওই কিশোরী চক্রের প্রধান রবিউলের স্ত্রী কেয়াকে জানায়, রহমত উল্লাহর অনেক টাকা আছে। তাঁকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করা সম্ভব। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ওই কিশোরী রহমত উল্লাহকে ফোন দেয়। জানায়, তাঁর এক বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠান। তিনি (রহমত উল্লাহ) যেন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। রহমত উল্লাহ তখন পুলিশবন্ধু মামুনকেও ওই অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানান। অফিস শেষে মামুন গত বছরের ৮ জুলাই নিজের মোটরসাইকেলে করে বনানীর ওই বাসার নিচে আসেন। আর নিজের প্রাইভেট কারে চড়ে আসেন রহমত উল্লাহ।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রহমত আর মামুন বাসার নিচে এলে পূর্বপরিচিত ওই কিশোরী সেখানে আসে। কিশোরীর সঙ্গে আরও দুজন নারী সেখানে আসেন। তাঁদের একজনকে ভাবি বলে পরিচয় করিয়ে দেয় ওই কিশোরী, অন্যজন তার বোন। এরপর ওই কিশোরীর সঙ্গে বাসায় যান মামুন ও রহমত। রহমত উল্লাহ তখন ওই কিশোরীকে বলেন, ‘তোমাদের নাকি বার্থডে পার্টি, কিন্তু তার তো কিছু দেখছি না।’ তখন চক্রের প্রধান রবিউলের স্ত্রী কেয়া বলেন, ‘প্রতিদিন তাঁদের বার্থডে পার্টি এ রকমই হয়। একটু পরই দেখতে পাবেন।’ আসামি কেয়া ওই কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আসেন আসামি স্বপন, দিদার, আতিক ও মিজান। মামুন ও রহমতের উদ্দেশে তাঁরা বলেন, ‘বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে তোরা এসেছিস।’

পুলিশ পরিদর্শক মামুন এর প্রতিবাদ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই চারজন আসামি মামুনকে মারতে শুরু করেন। স্বপন, আতিক ও দিদার বলেন, ‘ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলো। মেয়েদের সঙ্গে ছবি তুলে টাকা আদায় করা হবে।’ তখন মামুনকে চেপে ধরেন স্বপন, আতিক ও দিদার। স্কচটেপ দিয়ে হাত-পা বাঁধেন দিদার ও স্বপন। আসামি মিজান মুখ চেপে ধরলে মামুন তাঁর হাতে কামড় দেন। তখন মিজান ও দিদার পেছন থেকে মামুনের ঘাড়ে আঘাত করেন। আতিক মামুনকে সজোরে লাথি মারেন। মামুন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন রহমত উল্লাহকেও হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়।

অভিযোগপত্র আরও উল্লেখ করা হয়, রাত ১২টার দিকে স্বপন বলেন, ‘পুলিশ অফিসারের হাত-পা কেমন শক্ত মনে হচ্ছে। তখন প্রধান আসামি রবিউলকে এই তথ্য মুঠোফোনে জানানো হয়। রবিউলের পরামর্শে আসামি স্বপন, আতিক ও দিদার ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনের পায়ের আঙুল কেটে ফেলেন। রক্ত বের না হওয়ায় তাঁরা নিশ্চিত হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মারা গেছেন। স্বপন আর দিদার এখন কী করবেন, এ জন্য চক্রের প্রধান রবিউলকে ফোন দেন। রবিউলকে বড় একটা ট্রলি বা বস্তা নিয়ে আসতে বলেন। সকাল সাতটায় আসামি স্বপন, দিদার ও আতিক লিফটে করে মামুনের লাশ নিচে নিয়ে এসে প্রাইভেট কারের পেছনে ফেলে রাখেন। ওই প্রাইভেট কারের মালিক রহমত উল্লাহ। বনানী থেকে আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে বাঁশঝাড় দেখে আসামি স্বপন রহমত উল্লাহকে গাড়ি থামাতে বলেন। তখন গাড়ি থেকে লাশ বাঁশঝাড়ের মধ্যে নেওয়া হয়। আসামি আতিক লাশের গায়ে পেট্রল ঢেলে দেন। স্বপন দেন আগুন। এরপর রহমত উল্লাহ গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।