একসময় এলাকাটি ছিল বিস্তীর্ণ জনপদ, জঙ্গলাকীর্ণ এক অজপাড়াগাঁ। এখন সেখানে নির্মিত হয়েছে বড় বড় অবকাঠামো। স্থাপন করা হয়েছে নানা যন্ত্রপাতি। এখন এখানের মানুষের ঘুম ভাঙে মেশিনের টুংটাং শব্দে, হইহুল্লোড়ে। কর্মমুখর জনপদটি পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ নদের পারের ধানখালীতে অবস্থিত। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র।
‘পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এখন বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। আমদানি করা কয়লা দিয়ে চলা এটি দেশের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দুই বছর ধরে চলছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করার (সিনক্রোনাইজ) কাজ। পরীক্ষামূলক সে কাজও সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়েছে।
মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে সরকার সারা দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। আজ সোমবার ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধন উপলক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আশপাশের এলাকায় আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতর তৈরি করা হয়েছে পায়রা প্রতীকসংবলিত উদ্বোধনী ফলক। পাশেই সুধী সমাবেশের প্যান্ডেলের নির্মাণকাজ চলছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো ডিজিটাল ব্যানারসহ রংবেরঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে।
পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করতে প্রধানমন্ত্রী আসছেন, এমন খবরে উচ্ছ্বসিত স্থানীয় বাসিন্দারা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটবর্তী মাছুয়াখালী গ্রামের লিটন প্যাদা বলেন, ‘আমাগো পরিবারের ৫ একর জমি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের লাইগ্যা চইল্যা গেছে। ওই জমির ক্ষতিপূরণ পাইছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমাগো গ্রামে কোনো রাস্তাঘাট আছেলো না, বিদ্যুৎ আছেলো না। কুপিবাতি জ্বালাইয়া রাইত কাডাইতাম। অ্যাহন আর হেই দিন নাই। মোরাও বিদ্যুতের আলো পামু।’
চর নিশানবাড়িয়া গ্রামের আবুল কালাম ব্যাপারী বলেন, ‘কয়লা পোড়াইয়া বিদ্যুৎ বানাইবে। অনেকের কাছে হুনছি, কয়লা পোড়াইলে পরিবেশের ক্ষতি হইবে। এইতে কী যে হইবে হেইয়াই কইতে পারি না। তয় আমরা চাই, আমাগো যেন কোনো ক্ষতি না হয়।’
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ১৩তম দেশ হিসেবে আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল ক্লাবে প্রবেশ করছে। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এশিয়ায় সপ্তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে এ ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।
পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ও চীনের সমান অংশীদারত্বে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালিত হবে। এ জন্য গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তিতে চলবে। আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালিত হবে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বাড়তে থাকে। একই বছরের ২৬ আগস্ট দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে থাকে।
২০১৪ সালের ৯ জুন চীনের ন্যাশনাল মেশিনারি এক্সপোর্ট অ্যান্ড ইমপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) সঙ্গে বাংলাদেশের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ জন্য ১ হাজার ২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশেই ১৬ একর জমির ওপর ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ নামে আবাসিক পল্লি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্প পরিচালক শাহ আবদুল মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, এ প্রকল্পে প্রায় ২ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার খরচ হবে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য আগামী ১০ বছর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করা হবে। পরে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মোজাম্বিক থেকে কয়লা আমদানি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এনডব্লিউপিজিসিএল এবং বিসিপিসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হওয়ায় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের আগে এ ধরনের প্রযুক্তিতে কেন্দ্রটি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হয়ে বিশ্বের মধ্যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।