অরুণ বসু শ্রদ্ধাঞ্জলি: সম্পর্কে সম্প্রদায় হয় না
তিন দশক আগের মফস্বলে মানুষের সম্পর্কের স্মৃতি এখন গল্পের মতো শোনায়। কারও বাড়ির সন্তান মানে সে অত্র এলাকার সবার শিশু। সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুলকি তখন সব শিশুর আনন্দরাজ্য। সেই ফুলকিতে হঠাৎ হঠাৎ আসতেন একজন দীর্ঘদেহী মানুষ। জলদ্গম্ভীর কণ্ঠে তিনি আবৃত্তি করতেন আমাদের জন্য। তখনো আবহাওয়ার পূর্বাভাস সবার কাছে পৌঁছানোর মতো শক্তিশালী হয়নি।
১৯৯১ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে ফরিদপুর ফুলকির শিশুদের নিয়ে দুটো বাস রওনা হয়েছিল কুষ্টিয়ায়। কাঙাল হরিনাথের বাড়ি দেখে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি হয়ে ফেরা। তখন গড়াইয়ের পানি নেমে গিয়েছে। বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল। দুপুরে পৌঁছানোর সময় কোনো বিপত্তি হয়নি। রাতের অন্ধকারে গড়াইয়ের কাছাকাছি আসতেই চারপাশ সঙ্গে নিয়ে ছুটতে শুরু করল নদীমুখো বাতাস। ৩০ থেকে ৪০ শিশু-কিশোর আর তাদের অভিভাবকসহ সব মিলে প্রায় ১০০ মানুষ তখন অন্ধকারে ঝোড়ো বাতাসে আতঙ্কিত। ফরিদপুরের ফুলকির প্রধান অঞ্জলি বালা উপস্থিত থাকলে আর আমার তখন পৃথিবীর কাউকে প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ এই ভ্রমণে তিনি আমার অভিভাবক।
অন্ধকারের ভেতর তখন কে যে কার কী হয়, কেউ বুঝতে পারছে না। যে যাকে পারছে, হাত ধরে পার হচ্ছে সাঁকো। আমি সবাইকে হারিয়ে বাতাসের ঝাপটা সামলাতে না পেরে ভয়ে কাঁদছি। সারা শরীর, চোখ বালুতে তলিয়েছে। মনে হচ্ছে আর কোনো দিন বাড়ি ফেরা হবে না। এমন তীব্র বাতাসের চাবুক লাগছে চোখেমুখে, তখন অন্ধকারে সব ছায়ামূর্তি শুধু ছুটছে এলোমেলো। হঠাৎ এক হাত এক টানে কোলে তুলে নিল। আমার মাথা তাঁর কাঁধে গুঁজে রাখতে বলেই নিয়ে দৌড়ালেন। কোথায় যাচ্ছি, কে নিয়ে যাচ্ছেন, কিছুই জানি না। সেই বালুমেশানো বাতাস, গড়াই নদের হাতছানি—সবকিছু পরাজিত করে মানুষটা আমাকে নিয়ে এলেন বনভোজনের বাসে। সবাই তখন বিধ্বস্ত। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ ব্যাগ ফেলে এসেছে। বাতাস ক্রমাগত বাড়ছেই। কোল থেকে নামিয়ে সিটে বসে আবার নামলেন কাউকে এগিয়ে আনতে মানুষটা। ফেরার দুই দিন পর সবাই জেনেছিল, সেদিনের ঝড়ে উপকূলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। লাখের হিসাবটা জানা গিয়েছিল আরও অনেক পরে। অন্ধকারমেশানো সামান্য হলুদ আলোয় দেখলাম সে মানুষ অরুণ কাকু।
লেখার কয়েকটি বাক্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলাম বছর কয়েক আগে নাসিরনগরে মন্দিরে হামলার ঘটনার পর। তখন আমার কর্মস্থল ভিন্ন। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল—‘হ্যালো, আমি রে, অরুণ কাকু। সেদিনের কথা মনে রেখেছিস! বিপদের সময় মানুষের জন্য এগিয়ে গেলে ধর্মের ভেদ কারও মনে থাকে না, বোকা মেয়ে। এত বছর পর সে ঘটনা তোর লেখায় পড়ে বিশ্বাস করি, আমাদের পরের প্রজন্ম অনেক বেশি অসাম্প্রদায়িক।’ এমন বিশ্বাস তাঁর থাকবেই। কেননা, ২০১৪ সালে অরুণ বসু লিখেছিলেন, ‘দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না’। যে লেখার প্রতিটি বাক্যে আছে অসাম্প্রদায়িকতার আত্মবিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের আশ্রয় নেওয়া-দেওয়ায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ছিল না। সে গল্প অনেকেই সহজে সামনে আনেন না। অরুণ বসু অকপটে সে স্মৃতি লিখে বলেছিলেন, লুটপাট করা মানুষের পরিচয় দুর্বৃত্ত।
এ ঘটনার পর আমরা আবার হারিয়ে গেলাম নগরের ভিড়ে। তবু আমাদের সম্পর্কের গায়ে মিশে রইল মফস্বলের সেই শুদ্ধ সময়। ফোনে আলাপের চার বছর পর প্রথম আলোতে কাজ করতে এসে এবার আমার সহকর্মী হলেন অরুণ বসু। পুরো অফিসের অরুণদা আর আমার একার কাকু। লিফটে উঠতে-নামতে, চায়ের দোকানে এখন রোজ দেখা হয়। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের কক্ষে দেখা হয় প্রায়ই। মতি ভাইকে গড়াই নদে ঝড়ের রাতের গল্পটা একদিন খুব আগ্রহ নিয়ে শোনালেন অরুণ বসু। দুজনের একসঙ্গে উপস্থিতির ঘটনা ঘটলেই মতি ভাই বলেন, ‘মাহ্জাবীন, এই যে আপনার কাকু।’ তিনি যেন আনন্দ পেতেন বলে।
আনন্দ আমারই কি কম! এই অরুণ বসু মফস্বলের শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্বকোষের মতো। শুদ্ধ বানান শেখার উৎসাহী এ আয়োজক শিশুদের শুদ্ধ মাতৃভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি করিয়েছেন।
ফরিদপুরের মতো বহু শহরের শিক্ষার্থীরা জানে অরুণ বসুকে। আর আমি জানি, তিনি আমার কাকু। সেই কবে শৈশবে ফুলকির আবৃত্তি ক্লাসে সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আমাদের কবিতা পড়ে শোনাতেন এক দীর্ঘদেহী মানুষ, রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু...চরাব আজ বাজিয়ে ধেনু...। আমরা সেই কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত সব শব্দ কল্পনায় দেখতাম। ফুলের রেণু গায়ে মেখে চাঁপার বনে লুটিয়ে যাওয়ার বয়সই তখন ফুলকির শিশুদের।
এই তো কয়েক মাস আগে আরও একবার শুনলাম সেই কণ্ঠস্বর। আমাদের সহকর্মী সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুতে স্মরণ আয়োজন হলো। তাঁর আবৃত্তির সময় সম্পূর্ণ নীরবতা। প্রতিটি শব্দে মিশে রইল হারানোর সুর। অরুণ বসু পড়লেন—
‘আজিকে হয়েছে শান্তি,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে’
বছরও ঘুরে আসেনি। মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি আমাদের পড়ে শোনালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতাটি।
বিস্ময়ের ব্যাপার, এ কবিতার অধিকাংশটুকুই সেদিন তিনি না দেখে পড়লেন। কারওয়ান বাজারের প্রথম আলো অফিসের ১৩ তলায় বসে মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ফুলকির মাঠে অনেক শিশুমুখ। যাদের হাতে, জামায় লাল-নীল রং লেগেছে। বিকেলের আলো ডুবছে। গাঢ় হচ্ছে সামনের দীর্ঘদেহী মানুষটির কণ্ঠস্বর। মাঠের ঘাসে পা ডুবিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি আবৃত্তি করছেন—
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি
আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি’
ছুটি পেয়ে আজ অনন্তের যাত্রী হলেন অরুণ বসু নিজেই।