>
- মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ
- ১১ দিনে নিহত ৬৩
- এই অভিযান কতটা সমন্বিত তালিকা ধরে, তা পরিষ্কার নয়
- কত দিন চলবে, তা-ও জানা যাচ্ছে না।
সরকার বলছে, পাঁচটি সরকারি সংস্থার তথ্য সমন্বয় করে মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের তালিকা ধরেই সারা দেশে অভিযান চালানো হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর, র্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও বিভিন্ন জেলার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিজেরা নিজেদের মতো করে তালিকা ধরে এ অভিযান চালাচ্ছে, প্রতি রাতেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন একাধিক সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ী। অভিযান কত দিন চলবে, সে বিষয়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশের কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
দেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হওয়ার ১১তম দিনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৬৩-তে দাঁড়িয়েছে, যাঁদের প্রায় সবাই মাদক ব্যবসায়ী বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তবে এই বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমি বারবার বলছি, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো অবস্থাতেই তাদের ওপর গুলি করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হয়।’
কত দিন চলবে অভিযান
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির জন্য এত জোরেশোরে অভিযান চলছে।যত দিন না পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে বা মনে হবে মাদকের বেচাবিক্রি কমেছে, তত দিন এ অভিযান চলবে। আপাতত তিন শতাধিক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে এ অভিযান পুরোপুরি বন্ধ হবে না, ধরন পাল্টানো হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশির ভাগ কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমান বিচারিক ব্যবস্থায় মাদক নির্মূলে আর কোনো পদ্ধতি কার্যকর হবে না বলেই তাঁরা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড বা মেক্সিকোর অভিযানের উদাহরণ টানছেন তাঁরা। ওই সব দেশে মাদক নির্মূলের নামে কয়েক হাজার সন্দেহভাজনকে হত্যা করেছিল সরকারি বাহিনী। সেইভাবে শুরু হওয়া অভিযানকে সাধারণ জনগণ সমর্থন দিচ্ছে বলেও মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে জানান, যত দিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হবে, তত দিন এ অভিযান চলবে। আরও প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই অভিযান। আর মাদক নিয়ে কারও কোনো তদবিরও শোনা হবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে, তাদের নাম অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হচ্ছে।
সমন্বিত তালিকা নেই
দেশব্যাপী মাদকবিরোধী এই অভিযান নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সমন্বয় করা হচ্ছে বলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে। দেশব্যাপী অভিযান চালাচ্ছে মূলত র্যাব ও পুলিশ। তবে বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযানের বিষয়ে অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ বা সমন্বয় হচ্ছে না। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের হাতে এখনো সমন্বিত কোনো তালিকা গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পৌঁছায়নি। পুলিশ বলছে, দেশের ভেতরে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়েনি। মাদক ব্যবসায়ীরা ধাওয়া খেয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছেন। আর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কোনো বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে না বলে গতকাল জানিয়েছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা এ ধরনের ব্যাপক অভিযানে গোয়েন্দা তথ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য থাকলে মাদকের উৎস ও পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্ত করা সহজ হতে পারে। আর গোয়েন্দা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। দুটি বাদে সব কটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এ ক্ষেত্রে তাদের (স্বরাষ্ট্র) সমন্বয়ের কাজটা করতে হবে।
যে যার মতো
রংপুর রেঞ্জে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা অভিযান চালাচ্ছেন। তবে তাতে সদর দপ্তরের অনুমোদন রয়েছে। অভিযানে তাঁদের জেলায় বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছেন। এরপর মাদক ব্যবসায়ীরা ধাওয়া খেয়ে সীমান্তে চলে গেছেন। ওই কর্মকর্তার দাবি, এই জেলায় মাদকদ্রব্যের বেচাবিক্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, মাদকবিরোধী অভিযানের পুরোটাই তাদের গোচরে রয়েছে। আর আবার পুলিশ সদর দপ্তরে উপমহাপরিদর্শক ও সহকারী মহাপরিদর্শক পদের তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় গত বৃহস্পতিবার। তাঁরা বলছেন, তাঁরা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ প্রশ্নে কিছুটা ধীরে চলো নীতি মানতে চান, অন্য কোনো বাহিনীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চান না।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, সীমান্তে আরেকটু কড়াকড়ি করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। যে চারটি সংস্থা মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে বিজিবির গ্রেপ্তার সবচেয়ে কম। তবে তাদের উদ্ধার অনেক বেশি। তারা অনেক মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন অনেক কর্মকর্তা।
এদিকে বিজিবি সদর দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, সে অর্থে বিজিবির কোনো বিশেষ অভিযান নেই। নিয়মিত কাজই করে যাচ্ছে বাহিনীটি।
গত বৃহস্পতিবার কথা হয় র্যাবের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, পুলিশ সদরের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ আছে। তবে তাঁরা অভিযান চালাচ্ছেন নিজেদের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। মাঠপর্যায়ে তাঁদের ব্যাটালিয়নগুলো থেকে পাঠানো তথ্য যাচাই করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এ ক্ষেত্রে যাঁদের বিরুদ্ধে আগের একাধিক মামলা রয়েছে, এর আগে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, এ রকম লোকজন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
র্যাবের একজন পরিচালক বলেন, ‘এর মধ্যেই সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীরা এলাকা ছেড়েছেন। আর গণমাধ্যমে যাঁকে মাদকের গডফাদার বলা হচ্ছে, তাঁর কর্মকাণ্ডও কিন্তু নজরদারির বাইরে নেই। তবে তাঁর মাদক ব্যবসায় যুক্ত থাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
ঢাকার কী অবস্থা
র্যাবের ঢাকার একটি ব্যাটালিয়নের পরিচালক গত বৃহস্পতিবারই বলেছিলেন, ‘আমরা এখনো গবেষণা পর্যায়ে আছি, অচিরেই ঢাকায় অভিযান শুরু হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গেও একই দিনে কথা হয়। তিনি বলছিলেন, তাঁরাও মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য সংগ্রহ করছেন। তবে সত্যি কথাটা হচ্ছে, ঢাকার মাদক ব্যবসায়ীরা সব গা-ঢাকা দিয়েছেন বা তাঁরা ঢাকায় নেই। তাহলে ঢাকার অভিযান কি নিষ্ফল হবে, জানতে চাইলে মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘আগে শুরু হোক। তখন দেখবেন। মাদক ব্যবসায়ীরা যেমন বসে নেই, আমরাও কখনো বসে ছিলাম না।’
তবে গত বৃহস্পতিবার রাতেই অবশ্য তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে একজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনার মধ্য নিয়ে রাজধানী ঢাকাতেও অভিযান শুরু হলো।
প্রয়োজন সমন্বয়
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা আসে মূলত টেকনাফ ও চট্টগ্রাম হয়ে। সেসব জায়গায় যেসব মাদক ব্যবসায়ী ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা আছেন, তাঁদের কারবার লাখ লাখ ইয়াবা বড়ি নিয়ে। তাঁদের কাছ থেকে ইয়াবা আসে ঢাকা, চট্টগ্রাম বা ভৈরবের সাব-ডিলারদের কাছে। সেখান থেকে ঢাকাসহ বাইরের জেলাগুলোর পাইকারি ব্যবসায়ীরা ইয়াবা কিনে নিয়ে যান। পরে তা যায় খুচরো বিক্রেতাদের কাছে। ইয়াবার আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যিনিই দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা সেবন করছেন, তিনিই একপর্যায়ে নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য ইয়াবা বিক্রি করা শুরু করেন। এখন এ ধরনের নেশাসক্তকে ব্যবসায়ী বললেও বলা যায়। তবে সবার আগে ধরা প্রয়োজন ওপরের স্তরে থাকা ইয়াবা ডিলারদের।
ওই কর্মকর্তা বলেন, লালমনিরহাট বা মাদারীপুরের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তো সাব ডিলারদের কাছ থেকেই ইয়াবা কেনেন। ওই সব জেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর চেয়ে কক্সবাজারের চুনোপুঁটি ব্যবসায়ীও অনেক ভয়ংকর। সমন্বয় না হলে অনেক গডফাদার বা ডিলার অভিযানের বাইরে থেকে যাবেন।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের তরুণ, এমনকি মধ্যবয়সী ব্যক্তিরা যেভাবে মাদকের নেশায় পড়েছেন, তা দেশের জন্য ভীতিকর, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত। মাদক ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত এবং তাঁদের গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িয়ে পড়তে হবে। সম্প্রতি আমরা যা শুনছি, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’