২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার ‘সুযোগ দিচ্ছে’ টেলিটক

তদন্ত প্রতিবেদনে অবৈধ ভিওআইপি সহায়ক নানা কাজে টেলিটকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তারা জড়িত বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে।

  • সরকারি অপারেটর টেলিটক বাজারে সবচেয়ে পিছিয়ে।

  • ২০১৯-২০ অর্থবছরে অভিযানে ধরা পড়া সিমের ৭৫% টেলিটকের।

বিটিআরসি

সরকারি মুঠোফোন অপারেটর টেলিটকের একজন খুচরা বিক্রেতা বা রিটেইলার মাত্র ২৪ ঘণ্টায় একজন গ্রাহকের নামে ১৪টি সিম (গ্রাহক শনাক্তকরণ নম্বর) নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ১টি বাদে বাকি ১৩টি সিমের নম্বর একই সিরিয়ালের। একটি সিম নিবন্ধিত হওয়ার সময় রাত ৩টা ১৮ মিনিট। সিমগুলো ব্যবহার করা হয়েছে অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসায়।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে টেলিটক নানাভাবে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় রিটেইলাররা কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া বিপুল পরিমাণ সিম বিক্রি করছেন বলে বিটিআরসির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিম ধরা পড়ার পরের দিন কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার আগেই টেলিটক আগবাড়িয়ে সিম নিষ্ক্রিয় করেছে। অবৈধভাবে কল টার্মিনেশন রোধ করার নিয়মকানুনও টেলিটক যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে না।

ঘটনার শুরু গত ৩ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন র‌্যাব ও বিটিআরসির পরিদর্শকদের একটি দল রাজধানীর নিউমার্কেট, তুরাগ ও মিরপুরের শাহ আলী থানা এলাকায় অভিযান চালায়। এই অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে ব্যবহার করা বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এ সময় তিনজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা হয় ৩ হাজার ৪০০ সিম, যা টেলিটকের।

এরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিটিআরসি টেলিটকের রিটেইলারের সম্পৃক্ততা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত শুরু করে। গত ২৩ ও ২৪ মার্চ টেলিটকের নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার সরেজমিনে পরিদর্শন করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিটিআরসির দেওয়া প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক তদন্ত করা হবে। এতে কারও বিরুদ্ধে
অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা খুঁজে দেখব দায়দায়িত্ব কাদের ওপর ছিল, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না, কোনো পরিবেশক দায়ী কি না। কোনো মন্ত্রণালয় তার অধীন প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করতে পারে না।’

তদন্ত প্রতিবেদনে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে অবৈধ কাজে টেলিটক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা উঠে আসে। বিটিআরসির তদন্ত দল বলেছে, অবৈধ কাজে ব্যবহার করা সিম একই ব্যক্তির অনুকূলে একই রিটেইলারের মাধ্যমে বিক্রি এবং আইএমইআইয়ের (মুঠোফোন শনাক্তকরণ নম্বর) অনুকূলে একাধিক নম্বর বরাদ্দ করা অর্থাৎ বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন/অ্যাকটিভেশন—এ ক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় টেলিটকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় রিটেইলাররা কোনো ধরনের যাচাই–বাছাই ছাড়াই বিপুল পরিমাণ সিম বিপণন করে আসছে।

বিটিআরসির তদন্ত দল আরও বলেছে, টেলিটকের সেলস, ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড সিআরএম ডিভিশন ও সিস্টেম অপারেশন ডিভিশনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া শুধু পরিবেশক/রিটেইলার পর্যায়ে একই আইএমইআই ও জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুকূলে একাধিক সিম সিরিজ বিপণনের সুযোগ পাওয়ার কথা নয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে একটি সিম বন্ধের ঘটনা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি অবৈধ ভিওআইপি অভিযানের পরের দিন সিমটি নিষ্ক্রিয় করে দেয় টেলিটক। যদিও সিমটি বন্ধের কোনো নির্দেশনা তাদের দেওয়া হয়নি। বিটিআরসির তদন্ত দল বলছে, নম্বর নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে টেলিটকের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা জড়িত থাকতে পারেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিটকের রেগুলেটরি বিভাগের ব্যবস্থাপক এস এম লুৎফুল্লাহ হিল মুজিব প্রথম আলোকে বলেন, যদি কোনো কর্মকর্তা এসব কাজে জড়িত থাকতেন, তাহলে ৩ হাজার ৪০০ সিম ১ হাজার ৪৪৫ জন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত হতো না, অল্প কয়েকজন ব্যক্তির নামেই সিমগুলো নিবন্ধিত হতো। একটি সিম নিবন্ধনের পর আরেকটি সিম নিবন্ধন করতে একজন গ্রাহককে অন্তত তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে—তাহলে ২৪ ঘণ্টায় একজন গ্রাহক কীভাবে ১৪টি সিম নিবন্ধন করেছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিটিআরসি ভুল ব্যাখ্যা করেছে। গভীর রাতে বিমানবন্দরে সিম নিবন্ধন হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বিটিআরসির তদন্ত দল বলছে, একজন গ্রাহক ২৪ ঘণ্টায় ১৪ বার একই রিটেইলার পয়েন্টে গিয়ে তাঁর আঙুলের ছাপ দিয়েছেন—এটা বাস্তবসম্মত নয়। পুরো পদ্ধতিটি ভুয়া সিম নিবন্ধন করার সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে টেলিটকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সম্পৃক্ততা ও রিটেইলারের ভূমিকা সন্দেহজনক। প্রথমবার নিবন্ধিত সিমের গ্রাহকের বায়োমেট্রিক নমুনা কীভাবে অন্যান্য সময় ‘অ্যাকটিভেশন’ অ্যাপে সন্নিবেশ করা হয়, তা আরও অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে বের করা দরকার বলেও মনে করে তদন্ত দল।

আগবাড়িয়ে সিম নিষ্ক্রিয় করার বিষয়ে তদন্ত দল বলেছে, এর মাধ্যমে তথ্য গোপন করায় সহায়তা করার বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়।

বিটিআরসি সূত্র জানায়, তদন্ত প্রতিবেদনটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়গুলো মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আমাদের কার্যক্রমও চলমান আছে।’

সরকারি মালিকানাধীন অপারেটর হিসেবে ২০০৪ সালে টেলিটক যাত্রা শুরু করে। তবে এটি বাজারের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান। দেশের ১৭ কোটি ৬৪ লাখ সক্রিয় সিমের মধ্যে টেলিটকের গ্রাহক মাত্র ৬০ লাখ। বাজারের শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোনের গ্রাহক ৮ কোটির বেশি।

টেলিটক সিম ব্যবহার করে ভিওআইপির অভিযোগ নতুন নয়। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অবৈধ ভিওআইপি শনাক্তকরণ অভিযান হয়েছে ২১টি। এতে ১১ হাজার ৮০২টি সিম জব্দ করা হয়, যার ৭৫ শতাংশই টেলিটকের।

বিটিআরসির এবারের তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে যে টেলিটকের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন/অ্যাকটিভেশন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। রিটেইলারের এলাকা অনুযায়ী শনাক্ত করার পদ্ধতি না থাকায় খুব সহজেই দেশের যেকোনো জায়গা থেকে সিম নিবন্ধন করা যায়। এমনকি দুষ্টচক্র ঘরে বসেই সুবিধাজনক ব্যবস্থায় সিম নিবন্ধন করতে পারে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, নিউমার্কেট, তুরাগ ও শাহ আলী থানা এলাকার অভিযানে যে চক্রকে ধরা হয়েছিল, তারা প্রতিদিন আনুমানিক ৬ লাখ মিনিট আন্তর্জাতিক কল অবৈধভাবে ‘টার্মিনেট’ করতে পারত। এতে বছরে প্রায় ১১ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিত।

র‌্যাব-১০–এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো চলছে। চক্রটি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছিল। অনুসন্ধান শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।