অবৈধ কারখানা ও নকল পণ্য, ঝুঁকিতে জীবন
>
- অলিগলিতে কারখানা বানিয়ে বছরে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা
- দুই বছরে ১১২ কারখানা সিলগালা, ১৭৩ জনকে দণ্ড দেওয়ার পরও ব্যবসা থামেনি
- নকল প্রসাধনী, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ও বৈদ্যুতিক তার, এমনকি নকল ওষুধেরও প্রচুর কারখানা রয়েছে
- গুদাম ভাড়া দিলে দ্বিগুণ ভাড়া বেশি পান বলে লোভ সামলাতে পারেন না বাড়িওয়ালারা
নকল পণ্যের পাইকারি বাজার হিসেবে পুরান ঢাকার কিছু এলাকার পরিচিতি দেশজোড়া। গলি-ঘুপচিতে বহুতল আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে প্রসাধনী, প্লাস্টিকের অবৈধ কারখানা, গুদাম, যা সাংঘাতিক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যার প্রমাণ চুড়িহাট্টায় জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে মানুষকে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বহুযুগ ধরে পুরান ঢাকা নানা ব্যবসার কেন্দ্র। দেশীয় কোম্পানি ও আমদানি করা বিদেশি পণ্যের বিক্রির কেন্দ্রও পুরান ঢাকা। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, এই এলাকার প্রসাধনী, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, প্লাস্টিক পণ্য, রাসায়নিক, যন্ত্রাংশ ও ওষুধের পাইকারী ব্যবসা বছরে হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। তবে এই বিশাল অঙ্কের ব্যবসার বেশির ভাগটাই চলছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনুমোদন ছাড়া। এ এলাকায় নকল পণ্যের ব্যবসায়ীদের অবস্থানও অনেক শক্তিশালী। তাঁদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বৈধ ব্যবসায়ীরা।
গত দুই বছরে চকবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুর মিলে ১১২টি নকল পণ্যের কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসবের সঙ্গে যুক্ত ১৭৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায় হয়েছে ৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা। র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে নকল পণ্য ও অবৈধ কারখানাগুলো। চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে নকল বডি স্প্রের (সুগন্ধি) কারখানা ও গুদামের কারণে। তবে সমস্যা হলো, ধরার পর লোকগুলো কারাভোগ করে বা জরিমানা দিয়ে কয়েক দিন পর আবারও অন্য জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে একই কাজ শুরু করে করছে।
এদিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবৈধ প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রির অভিযোগে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই ৯৪টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে, ৮টি কারখানা সিলগালা ও ২৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে। এ ছাড়া আবার প্রসাধনী ভরে (রিফিলিং) বাজারে বিক্রির জন্য রক্ষিত ১৮ ট্রাক নামী ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর কৌটা ধ্বংস করেছে সংস্থাটি।
র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেটের হিসাবমতে, পুরান ঢাকার নকল প্রসাধনী, নকল ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ও বৈদ্যুতিক তার, অবৈধ পলিথিন এমনকি নকল ওষুধেরও প্রচুর কারখানা রয়েছে গলি–ঘুপচির মধ্যে। আর এসব কারখানা চালাতে যে রাসায়নিকগুলো লাগে, সেগুলো আবার আরেক ধরনের ব্যবসায়ী এনে মজুত করে রাখেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বসতবাড়িতেই এসব কারখানা ও রাসায়নিকের গুদাম। এসব কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ‘প্রশাসনের’ লোকদের ‘ম্যানেজ’ করছেন বলেও র্যাবের কাছে খবর আছে। যে কারণে বছরময় অভিযান চালিয়েও এসব ব্যবসা থামানো যাচ্ছে না। আর বাড়িওয়ালারাও কারখানা বা গুদাম ভাড়া দিলে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিন গুণ ভাড়া বেশি পান। তাই এ লোভও তাঁরা এড়াতে পারেন না।
র্যাব ও বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকায় যে বাড়িগুলোতে কারখানা করা হয়েছে, অভিযানের সময় সেগুলোর রাজউকের অনুমোদনও দেখাতে পারেন না মালিকেরা। অবৈধ পণ্যগুলোর বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই। এমনকি কারও সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্তও নেই। কারখানার জন্য ফায়ার সার্ভিস বা শিল্প মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই বেশির ভাগের। কোনো কোনো রাসায়নিক পণ্যের মজুতের জন্য বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসনের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। এখানকার ব্যবসায়ীরা এসবের ধারই ধারেন না। বেশির ভাগই ব্যবসা করে যাচ্ছেন অনানুষ্ঠানিকভাবে। এমনকি অনেকে ব্যাংকিং চ্যানেলেও টাকা লেনদেন করেন না।
ঢাকা জেলা ক্ষুদ্র প্রসাধনী প্রস্তুতকারক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, অলিগলিতে নকল কারখানাগুলোতে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটে, এগুলো সাংঘাতিক ঝুঁকি তৈরি করছে। আর নকল প্রসাধনীর দৌরাত্ম্যে তাঁদের ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে। নকলবাজেরা অনেক শক্তিশালী, সবাইকে ম্যানেজ করে চলছেন। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত আসেন, কিছু শাস্তি দিয়ে চলে যান। কিন্তু শাস্তি পেয়ে আবারও একই কাজ শুরু করেন নকল পণ্যের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের কারণে কোনো দেশি ব্র্যান্ড তৈরি হচ্ছে না। পুরান ঢাকা থেকে গড়ে ওঠা ব্র্যান্ড যেমন ম্যানোলা, ফুজি, এলিট—এসবের অস্তিত্বও বিলীনের পথে।
নকল পণ্য, অবৈধ কারখানা
সারা দেশ থেকেই ব্যবসায়ীরা এসব নকল পণ্য কিনতে চকবাজারে আসেন। ব্যবসা হয় ফোনেও। সব মিলিয়ে এখানে বেচাবিক্রি প্রচুর। কী নেই পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের ভান্ডারে? নকল সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, সুগন্ধি, লিপস্টিক, নেইলপলিশ, আইলাইনার, ফেসওয়াশ, বডিওয়াশ—সব ধরনের প্রসাধনী এখানকার বাজারে সস্তা দামে পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকার নামীদামি কোম্পানি থেকে শুরু করে ভারতীয় এমনকি দেশীয় কোম্পানির ‘চালু’ পণ্যটিও তাঁরা নকল করে বাজারজাত করছেন। লিপস্টিক, নেইলপলিশ, বডি স্প্রে, কিছু ধরনের শ্যাম্পু ও লোশনের কৌটাগুলো কিনে আনা হচ্ছে চীন থেকে। আবার দেশের ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও কেউ ভালো কৌটা সংগ্রহ করেন। এসব কৌটায় দেশীয় ছাপাখানা থেকে ছাপিয়ে নেওয়া স্টিকার, হলোগ্রাম, বারকোড ইত্যাদি বসিয়ে একেবারেই আসলের মতো করে তোলা হচ্ছে। কোনো কোনো পণ্যে বসানো হয় আমদানিকারকের স্টিকারও, যাতে পণ্যটি আমদানি করে আনা হয়েছে বলে ক্রেতার বিশ্বাস অর্জন করা যায়।
তবে সব পণ্যই দাহ্য নয়। যেমন: নেইলপলিশ, রিমোভার, অনেক ধরনের তেল, বডি স্প্রে ইত্যাদি। সিগারেট লাইটারের গ্যাস দিয়ে বডি স্প্রে রিফিল করার কারখানাটিতে আগুন লেগেই চুড়িহাট্টায় জীবনের এত ক্ষয়ক্ষতি। আবার ক্রিম, শ্যাম্পুর মতো পণ্যগুলো দাহ্য নয়।
একজন ব্যবসায়ী জানান, ‘মোম’ বলে পরিচিত একধরনের তেলের সঙ্গে রং ও সুগন্ধি মিশিয়ে তৈরি হয় লিপস্টিক। নেইলপলিশে থাকে স্পিরিট। শ্যাম্পু তৈরি হয় শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত তরল সাবান থেকে। প্রয়োজন অনুযায়ী রং মিশিয়ে সাদা, কালো, গোলাপি রঙের শ্যাম্পু তৈরি করা হয়। আগে বড় হাঁড়িতেই এসবের মিশ্রণ করা হতো। এখন কেউ কেউ মিশ্রণযন্ত্র কিনে নিয়েছেন।
চকবাজার বণিক সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েক বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে সমিতির পক্ষ থেকে নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু লাভের লোভে ব্যবসায়ীরা থামছেন না। নজরদারি বাড়ায় এর মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী পুরান ঢাকা ছেড়ে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাড়ে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ভাড়া নিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন। তবে বিক্রির জন্য সেই পণ্যগুলো আবারও নৌকায় চকবাজারে আনছেন তাঁরা।
র্যাব জানিয়েছে, পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করা ত্বক ফরসা করার ক্রিমে তারা উচ্চমাত্রায় পারদ ও হাইড্রোকুইনান পেয়েছে। যেগুলো মুখে দিলে চামড়া ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার আশপাশে শ্রমিক এলাকাগুলোয় এবং মফস্বলের বাজারগুলোতে এই ক্রিমের প্রচণ্ড চাহিদা।
মৌলভি বাজারের হাজী হাবিবুল্লাহ মার্কেটের বরাত স্টোরে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ বর্গফুট আয়তনের দোকানটি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যান্ডের প্রসাধনীতে ঠাসা। এর মধ্যে ডাভ সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, ক্রিম, পন্ডস পাউডার, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, সানসিল্ক শ্যাম্পু, ভাটিকা, কুমারিকা, আমলা তেলের মজুত ছিল চোখে পড়ার মতো। ডাভের পণ্যগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই দেখে জিজ্ঞেস করতেই দোকানটির ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিন বলেন, ডাভের এই পণ্যগুলো তাঁরা থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করেছেন। এসব পণ্যের গুণগত মান অনেক ভালো। তাই কোম্পানি তারিখ লেখেনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ রকম চলছে বহুযুগ ধরেই। কেবল একটা প্রাণঘাতী ঘটনার পরেই এসব নিয়ে আলোচনা হয়। এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয় যে সব দোষ ব্যবসায়ীদের।
সামগ্রিক বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু প্রসাধনী নয়, ওষুধও নকল হচ্ছে। সেটা আরও ভয়াবহ। তিনি আরও বলেন, পুরান ঢাকায় এসব অপরাধ দমনে কার্যক্রম অপর্যাপ্ত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ম্যাজিস্ট্রেট গেলেন, তিনি কিছু জরিমানা করলেন, তারপর ভুলে গেলেন। এসব ব্যবসা পুরোপুরি সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত সংস্থাগুলোকে অন্তত প্রতি সপ্তাহে অভিযান চালাতে হবে।