জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ‘ক্ষতি ও লোকসান’ তহবিল চালুর পরামর্শ প্রধান উপদেষ্টার
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে ‘ক্ষতি ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিল’ চালুর পরামর্শ দিয়েছেন। স্থানীয় সময় শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ পরামর্শ দেন।
অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতাকালে ড. ইউনূস বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সবার অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এই গ্রীষ্মে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী তাপপ্রবাহ আমাদের জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কথা স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আমাদের যা প্রয়োজন, তা হলো জলবায়ু–সম্পর্কিত ন্যায়বিচার। যাতে করে দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত, উদাসীন আচরণ কিংবা এর মাধ্যমে সাধিত ক্ষতির বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের দায়বদ্ধ করা যায়। জলবায়ু-পরিবর্তনজনিত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছি, প্যাথোজেনের পরিবর্তনের ফলে নতুন রোগ বাড়ছে, ক্রমহ্রাসমান পানিসম্পদ ঝুঁকিতে ফেলছে আমাদের বাসযোগ্যতাকে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে প্রতিনিয়ত।’ ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার ক্রমবর্ধমান তীব্রতা এবং কম্পাঙ্কের ক্ষয়ক্ষতিকে উপেক্ষা করা যায় না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন,‘ক্ষুদ্র কৃষক এবং প্রান্তিক পর্যায়ে জীবিকা অন্বেষণকারীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমি আজ যখন এই বিশ্ব সভায় কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ৫০ লাখের বেশি মানুষ তাদের জীবদ্দশায় হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলা করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস আমাদের দেখিয়েছেন যে বিদ্যমান পরিক্রমা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে অভিযোজনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি।’ এ ছাড়া উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ও অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ কার্যকর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘একইভাবে আমাদের প্রয়োজন প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। নির্দিষ্ট করে বললে, আমাদের দরকার জীবনরক্ষাকারী প্রযুক্তি, বিশেষত কৃষি, পানি ও জনস্বাস্থ্য খাতে। যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভাবন এবং সমাধান ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পারে।’
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘জলবায়ু–সংকট মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের যুগপৎভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায় এখন কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে মনোযোগী হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে এ ধরনের পরিবর্তনের সুফলভোগী করতে হলে নেট-জিরো পৃথিবীর লক্ষ্য সমানভাবে পূরণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে সঙ্গে নিতে হবে। তা না হলে ‘পারস্পরিক দায়িত্ববোধের’ মাধ্যমে ‘পারস্পরিক সমৃদ্ধি’ অর্জনে আমাদের সর্বজনীন অঙ্গীকার পূরণে আমরা পিছিয়ে পড়ব। সমগ্র বিশ্ব একঙ্গে ‘তিন-শূন্য’র ধারণা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি তরুণ-তরুণী চাকরিপ্রার্থী না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবেন। তাঁরা যেন সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজ নিজ সৃজনশীলতার বিকাশ করতে পারেন। যেখানে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য আনতে মনোযোগী হতে পারে। যেখানে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি ভোগবাদী জীবনধারা উত্তরণ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সৃজনশীল শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।’
ড. ইউনূস আরও বলেন, এই সময়ে প্রয়োজন উন্নত ও উন্নয়নশীল সব দেশ ও বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন একতা। তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এই লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘব্যবস্থা, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সরকার, সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অংশীজন (এনজিওগুলো) এবং দাতব্য সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামাজিক ব্যবসাকে স্থান দিলেই নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। এই পদক্ষেপ একই সঙ্গে জলবায়ুর ধ্বংসাত্মক গতিকে সফলভাবে রোধ করতে পারে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে।’
এ বিষয়ে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ভাষণের শুরুতে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট প্রদান এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকার জন্য আন্তোনিও গুতেরেসের প্রশংসা করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যৎ চুক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘোষণা অ্যাজেন্ডা ২০৩০–এর বাইরে পথ নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। তিনি বলেন, ‘শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফল আমাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে এবং উত্তরসূরিদের জন্য সহযোগিতার পুনর্বিবেচনা করার ক্ষেত্রে একটি গাইড ফ্রেমওয়ার্ক হিসেবে কাজ করবে বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে।’