ঘুরেফিরে ঢাকায় থাকছেন ওসিরা
ডিএমপির ৫০ থানার মধ্যে অন্তত ১৩ থানার ওসি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঘুরেফিরে ডিএমপিরই বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশ পরিদর্শক বি এম ফরমান আলী ২০১৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন। পরে তাঁকে মতিঝিল থেকে বনানী থানার ওসি হিসেবে বদলি করা হয়।
সেখান থেকে ডিএমপির বিমানবন্দর থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। পুলিশের এই কর্মকর্তাকে গত বছর গুলশান থানার ওসি করা হয়। প্রায় ১০ বছর ঘুরেফিরে তিনি ডিএমপিরই বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে মো. মোস্তাজিরুর রহমান ডিএমপির খিলক্ষেত থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে তাঁকে মিরপুর মডেল থানায় বদলি করা হয়। তিনি এখন ডিএমপির ওয়ারী থানার দায়িত্ব পালন করছেন।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিএমপির ওসিদের এক নির্বাচনী এলাকা থেকে অন্য নির্বাচনী এলাকায় বদলি করা হবে। মঙ্গলবারের (আগামীকাল) মধ্যে ওসিদের বদলির আদেশের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান
শুধু ফরমান আলী ও মোস্তাজিরুরই নন, তাঁদের মতো আরও ১১ জন ওসি নানাভাবে ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ঘুরেফিরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় থাকছেন। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে থানার ওসিদের বদলির নিয়ম রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র। ডিএমপির ৫০ থানার মধ্যে অন্তত ২১ থানার ওসি ডিএমপিতেই দুই বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে দেশের সব থানার ওসিদের পর্যায়ক্রমে বদলির নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও আইজিপিকে চিঠি পাঠিয়ে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ওসিদের বদলির প্রস্তাব ইসিতে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ ঢাকার বাইরে থেকে কোনো ওসিকে ডিএমপিতে এনে দায়িত্ব দেওয়া হলে কিছু বুঝে উঠতে পারবেন না। অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতেই ওসিদের ঘুরেফিরে ডিএমপিতে রাখা হচ্ছে। বহু বছর ধরেই এসব হয়ে আসছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিএমপির ওসিদের এক নির্বাচনী এলাকা থেকে অন্য নির্বাচনী এলাকায় বদলি করা হবে। মঙ্গলবারের (আগামীকাল) মধ্যে ওসিদের বদলির আদেশের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
একই এলাকায় একজন ওসির দীর্ঘ সময় থাকার কারণে স্থানীয় রাজনীতিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই কারণে নির্বাচন বা অন্য কোনো বিষয় থাকলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ ওসির সহানুভূতি পেতে পারেন।পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ
পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় ওসি হওয়ার ‘মূল যোগ্যতাই’ হচ্ছে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। স্বাভাবিকভাবেই এ পন্থায় নিয়োগ পাওয়া ওসিরা অনেকেরই নির্দেশ মানতে চান না। তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সহজে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। দিনের পর দিন তাঁরা ডিএমপিতেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।
ওয়ারী থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান মিরপুর থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মিরপুরের বাসিন্দা মখসেন উদ্দিনের অভিযোগ ছিল, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বরে পুলিশ পরিচয়ে দুর্বৃত্তরা তাঁর বায়না করা প্লটে ঢুকে বাড়ির নিরাপত্তা (সিসি) ক্যামেরা-জানালা ভেঙে ঢুকে তত্ত্বাবধায়ককে মারধর করে স্বর্ণালংকার এবং মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
ওই দিন প্লটের তত্ত্বাবধায়ক জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’–এ ফোন দিলে মিরপুর থানার পুলিশ আসে। তখন দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে মখসেন উদ্দিন মিরপুর থানায় মামলা করতে গেলে ওসি মোস্তাজিরুর মামলা নেননি। বিষয়টি নিয়ে মখসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে মিরপুর বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার জসীম উদ্দিন মোল্লা ওসি মোস্তাজিরুরকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপরও মামলা নেননি। পরে ওসি মোস্তাজিরুরকে ওয়ারীতে বদলি করা হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, মূলত প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকে বলে ওসিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। কোনো কোনো সময় তাঁরা পুলিশ বিভাগেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মানতে চান না। এ ছাড়া ডিএমপিতে ওসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের লেনদেনের কথাও শোনা যায়।
২০১৪ সালে কদমতলী থানার ওসি হন মাজহারুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ওসি হিসেবে কর্মরত। প্রায় ৯ বছর ধরে তিনি ডিএমপিতেই আছেন। মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক।
বিমানবন্দর থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসির আরাফাত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ডিএমপিতে আছেন। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি মুন্সী ছাব্বির আহম্মেদ ১০ বছর, পল্টন থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন মিয়া ১০ বছর, কাফরুল থানার ওসি ফারুকুল আলম ৯ বছর, ধানমন্ডি থানার ওসি পারভেজ ইসলাম ৮ বছর, তুরাগ থানার ওসি মওদুত আহমেদ ৮ বছর, কদমতলী থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা ৭ বছর, খিলক্ষেত থানার ওসি কাজী সাহান হক ৭ বছর, ভাষানটেক থানার ওসি জানে আলম মুনশী ৬ বছর এবং দক্ষিণখান থানার ওসি সিদ্দিকুর রহমান ৫ বছর ধরে ডিএমপিতেই আছেন।
এ ছাড়া সূত্রাপুর থানার ওসি মঈনুল ইসলাম ৪ বছর, মতিঝিলের ওসি আবুল কালাম আজাদ ৪ বছর, যাত্রাবাড়ীর ওসি মফিজুল আলম ৪ বছর, শেরেবাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া ৩ বছর, গেন্ডারিয়ার ওসি আবু সাঈদ আল মামুন ৩ বছর, লালবাগের ওসি হেলাল উদ্দিন প্রায় আড়াই বছর এবং উত্তরখান থানার ওসি আবুল কালাম ২ বছরের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপিতে।
এ ছাড়া ভাটারা থানার ওসি মাইনুল ইসলাম ৮ বছর ডিএমপির একাধিক থানায় ওসি হিসেবে থাকার পর ঢাকার বাইরে বদলি হন। সম্প্রতি তাঁকে আবার ডিএমপিতে এনে ভাটারা থানারই ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, একই এলাকায় একজন ওসির দীর্ঘ সময় থাকার কারণে স্থানীয় রাজনীতিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই কারণে নির্বাচন বা অন্য কোনো বিষয় থাকলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ ওসির সহানুভূতি পেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সুষ্ঠু তদারকি দরকার। আর নির্বাচন কমিশন ওসিদের বদলির যে আদেশ দিয়েছে, সেটা ভালো পদক্ষেপ।