ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
তুলে নেওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর শামসুজ্জামান কারাগারে
প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার দেখানো হলো রমনা থানায় করা নতুন মামলায়। এই মামলা করা হয় তাঁকে তুলে নেওয়ার ১৯ ঘণ্টা পর।
সিআইডি পরিচয়ে সাভারের বাসা থেকে তুলে নেওয়ার ৩৫ ঘণ্টা পর প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। আর তুলে নেওয়ার ৩০ ঘণ্টা পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাঁকে কারাগারে আটক রাখার জন্য আদালতে আবেদন করে রমনা থানার পুলিশ।
অন্যদিকে শামসুজ্জামানের পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা জামিন চেয়ে আবেদন করেন। সে আবেদনের শুনানি শুরু হয় বেলা দুইটার দিকে। তখন হাজতখানা থেকে শামসুজ্জামানকে আদালতে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়। শুনানি শেষে জামিন আবেদন নাকচ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন। এরপর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রিজন ভ্যানে করে তাঁকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।
গত বুধবার ভোর চারটার দিকে সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না শামসুজ্জামানের। তিনি প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে সাভারে কর্মরত। তুলে নেওয়ার পৌনে দুই ঘণ্টা আগে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম মামলা হয়। এ মামলার বাদী যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া। যদিও মামলার বিষয়টি জানা যায় বুধবার দুপুরের দিকে। তবে গতকাল তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয় রমনা থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা নতুন আরেকটি মামলায়। এই মামলা হয় তাঁকে তুলে নেওয়ার ১৯ ঘণ্টা পর গত বুধবার মধ্যরাতে।
রমনা থানার যে মামলায় শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, সেই মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে। এ মামলার বাদী হাইকোর্টের আইনজীবী আবদুল মালেক (মশিউর মালেক)।
শামসুজ্জামানকে সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হলেও গতকাল আদালতে দেওয়া এক প্রতিবেদনে রমনা থানার পুলিশ অবশ্য ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছে। তাদের দাবি, ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানোর পর বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের আশপাশের এলাকা থেকে শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাহলে তুলে নেওয়ার পর ২০ ঘণ্টার বেশি সময় শামসুজ্জামান কোথায় ছিলেন, এ বিষয়ে পুলিশ কোনো তথ্য দেয়নি। এমনকি তাঁকে কারা তুলে নিয়েছিল, সে বিষয়েও থানা-পুলিশ বা সিআইডির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সিআইডি শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে আরও মামলা হয়েছে, সেসব মামলায় তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দু-তিনটির খবর জানি, আরও মামলা হচ্ছে, আমরা শুনছি। এখনো আমাদের কাছে আসেনি।’
তুলে নেওয়ার ২০ ঘণ্টা পর হঠাৎ ফোনকল
সাভার থেকে তুলে নেওয়ার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৩৬ মিনিটে শামসুজ্জামানের মুঠোফোন নম্বর থেকে প্রথম আলোর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মীর কাছে একটি কল আসে। ফোনে শামসুজ্জামান বলেন, তাঁকে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের (বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র) সামনে সিআইডি নামিয়ে দিচ্ছে। শামসুজ্জামানের এই কল পাওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় প্রথম আলোর দুজন কর্মী সেখানে পৌঁছান। কিন্তু সেখানে শামসুজ্জামানকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
সিআইডির একটি সূত্র বলছে, ফোনে ডেকে নেওয়া হয় শামসুজ্জামানের বন্ধুস্থানীয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রনেতাকে। তিনি বুধবার রাত সোয়া ১১টার দিকে সিআইডি কার্যালয়ে পৌঁছান। সিআইডি তাঁর জিম্মায় শামসুজ্জামানকে বুঝিয়ে দিচ্ছে মর্মে কাগজে লিখে সই নেয়। শামসুজ্জামানকে তাঁর ফোন ফেরত দেওয়া হয়। এরপর দুজনকে সাভারের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তাঁদের সিআইডির একটি গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িটি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের কাছে এসে থেমে যায়। সেখানে আরেকটি গাড়ি আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল। সেই গাড়িতে শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়া হয়। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ওই ছাত্রকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. হারুন অর রশীদের সঙ্গে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহর সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
আইনমন্ত্রী যা বললেন
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা এবং প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তুলে নিয়ে দীর্ঘ সময় পর গ্রেপ্তার দেখানো নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
একজন সাংবাদিক আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। কিন্তু বলা হয়েছিল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে সেলে পাঠানো হবে...। তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এটা ঠিক যে বলা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় যখন তথ্য দেওয়া হবে, তখন প্রাইমাফেসি কেস (অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা) নির্ধারণ করার জন্য আগে একটি সেলে পাঠানো হবে এবং সেলের পরীক্ষান্তে মামলা নেওয়া হবে। কিন্তু গতকাল (বুধবার মধ্যরাতে) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলাটি করা হয়েছে, তার যে ক্লিপ, তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলা হয়, তার তথ্য-উপাত্ত ছিল। সে জন্য মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গত ২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার সময় গ্রাফিক কার্ডে ছবির অমিলকে কেন্দ্র করে দেশের ভাবমূর্তি ও অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা হয়েছে। যদিও ফেসবুকে দেওয়া গ্রাফিক কার্ডের অসংগতি দ্রুতই নজরে আসার পর তা সরিয়ে নিয়ে প্রথম আলো সংশোধনী প্রকাশ করেছে।
শুনানিতে যা হলো
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শামসুজ্জামানকে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে আসে রমনা থানা-পুলিশ। পরে তাঁকে রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। বেলা দুইটার দিকে তাঁকে আদালতের এজলাসে তোলা হয়।
রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে একজন ব্যক্তি কী করে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন, শুনানিতে সেই প্রশ্ন তোলেন শামসুজ্জামানের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় এই মামলা করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে যে মামলা, সেখানে রাষ্ট্র তো কোনো অভিযোগ করেনি। সুতরাং মামলাটি আইনত ত্রুটিপূর্ণ। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সাংবাদিক শামসুজ্জামানের জামিন মঞ্জুর করার আবেদন জানান তিনি।
এর আগে আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার শুনানিতে বলেন, সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। এই মামলার এজাহারে যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।
শামসুজ্জামানের পক্ষে আদালতে আরও উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মাহবুবুল হক, আশরাফ-উল-আলম, চৈতন্য চন্দ্র হালদার, সুমন কুমার রায়, বাহাউদ্দিন ইমরান। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) হয়ে আইনজীবী মশিউর রহমানও শামসুজ্জামানের পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
শুনানিতে জামিনের বিরোধিতা করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগের উপপরিদর্শক নিজাম উদ্দিন ফকির।
আইনের লঙ্ঘন
মধ্যরাতে সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ধর্ষ কোনো অপরাধী না হলে মধ্যরাতে বাসা থেকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাটি হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী। গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের ব্যবহার করতে পারে না। তিনি বলেন, প্রথম আলোর সাংবাদিকের ক্ষেত্রে মধ্যরাতে তুলে নেওয়া, মামলা দেওয়া এবং কোথায় রাখা হয়েছে তা দীর্ঘ সময় না জানানো—পুরো প্রক্রিয়াতেই আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।