মুক্তিযুদ্ধ সর্বোচ্চ গৌরবের, চব্বিশ তার ধারাবাহিকতা

একজন মুক্তিযোদ্ধা ও গণ-অভ্যুত্থানের দুজন সংগঠকের আলাপচারিতায় উঠে এল মুক্তিযুদ্ধ ও গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও আকাঙ্ক্ষার কথা।

জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে আলাপচারিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) বজলুল গনি পাটোয়ারী, বীর প্রতীক (মাঝে) এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত (ডানে) ও লিয়াজোঁ কমিটির সাবেক সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীব (বাঁয়ে)। ১১ ডিসেম্বর, সাভারেছবি: জাহিদুল করিম

‘আমার সমসাময়িক অনেকেই বেঁচে নেই। কাউকে হারিয়েছি যুদ্ধের ময়দানে। কাউকে হারিয়েছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে।’—সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে কী মনে হয়েছে, জানতে চাইলে কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) বজলুল গনি পাটোয়ারী।

বজলুল গনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। রণাঙ্গনে সম্মুখসমরে তিনি ছিলেন যুবক। এখন ৮৫ বছরের প্রবীণ। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর আয়োজনে ‘একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের কথোপকথন’ শীর্ষক আলাপচারিতায় অংশ নিতে সাভারে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে তিনি রাজি হলেন সানন্দে। বয়স, শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দেখালেন না।

১১ ডিসেম্বর বুধবার আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছালাম দুপুর ১২টার দিকে। সঙ্গে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই সংগঠক আরিফুল ইসলাম আদীব ও নাজিফা জান্নাত।

স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে তিনি বসলেন, হাঁটলেন, কথা বললেন, ছবি তুললেন। আর জানালেন মুক্তিযুদ্ধের কথা। কীভাবে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন, কী স্বপ্ন ছিল—সবকিছুই উঠে এল চব্বিশের দুই সংগঠকের প্রশ্নে।

ঠিক কত বছর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন, তা মনে করতে পারলেন না বজলুল গনি। বললেন, ৩০ থেকে ৩৫ বছর হবে। স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে তিনি বসলেন, হাঁটলেন, কথা বললেন, ছবি তুললেন। আর জানালেন মুক্তিযুদ্ধের কথা। কীভাবে তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেন, কী স্বপ্ন ছিল—সবকিছুই উঠে এল চব্বিশের দুই সংগঠকের প্রশ্নে। তিনি (বজলুল গনি) জানালেন, তাঁরা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তা অনেকাংশে পূরণ হয়নি।

অন্যদিকে চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দুই সংগঠকের কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল গনি জানতে চাইলেন কীভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নিল, কীভাবে তাঁরা আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন, দেশ নিয়ে তাঁদের ভাবনা কী—ইত্যাদি। গণ-অভ্যুত্থানের দুই সংগঠক বললেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলেই চব্বিশে তাঁদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চলবে। তাঁরা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চ গৌরবের। একাত্তর ও চব্বিশ মুখোমুখি করার মতো বিষয় নয়; বরং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান একাত্তরের ধারাবাহিকতা।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে দেয়ালে জাতীয় পতাকা আঁকছেন এক শিল্পী। সেখানে জাতীয় পতাকা হাতে নবীন প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। গতকাল বিকেলে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়
ছবি: দীপু মালাকার

তাঁদের পরিচয়

বজলুল গনি ১৯৭১ সালে মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর (তৎকালীন মেজর), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ তাহের (তৎকালীন মেজর) ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের (তৎকালীন মেজর) সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ওই সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মেজর মঞ্জুরের স্ত্রী, শিশুপুত্র, কন্যা ও বাঙালি সৈনিক আলমগীর খান। দুই দফার চেষ্টায় তাঁরা পাকিস্তানের শিয়ালকোট সীমান্ত হয়ে ভারতে ঢুকতে সমর্থ হন। সেখান থেকে তাঁদের পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর (তৎকালীন মেজর) ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ তাহের। এম এ মঞ্জুর মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একদল সেনাসদস্যের হাতে প্রাণ হারান। তখন মেজর জেনারেল মঞ্জুর সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) ছিলেন। ওই বছরের ১ জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সামরিক হেফাজতে তাঁকে হত্যা করা হয়।

তাহের ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার। যুদ্ধের সময় সম্মুখসমরে আহত হয়ে তিনি একটি পা হারান। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পেয়েছিলেন বীর উত্তম খেতাব। ১৯৭৫ সালের ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বরের পর বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে তাহেরের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই ভোররাতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের দুই সংগঠক বললেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বলেই চব্বিশে তাঁদের রাস্তায় নামতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চলবে। তাঁরা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সর্বোচ্চ গৌরবের। একাত্তর ও চব্বিশ মুখোমুখি করার মতো বিষয় নয়; বরং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান একাত্তরের ধারাবাহিকতা।

জিয়াউদ্দিন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন জেড ফোর্সের অধীনে থাকা প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর তিনি ভারতের সঙ্গে করা সরকারের একটি চুক্তির সমালোচনা করে পত্রিকায় নিবন্ধ লেখেন। তখন তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে সাধারণ ক্ষমার অধীনে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। এখন তিনি অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

তখনকার ক্যাপ্টেন বজলুল গনি একাত্তরের রণক্ষেত্রে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (সিনিয়র টাইগার্স) ডেলটা (ডি) কোম্পানির নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুদ্ধ করেছেন সিলেট সীমান্তে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।

আরিফুল ইসলাম আদীব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তিনি মূলত আত্মগোপনে থাকা মূল সমন্বয়কদের বার্তা, বিজ্ঞপ্তি, কর্মসূচি ইত্যাদি দেশি-বিদেশি কিছু গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছে দিতেন। তাঁকে তখনকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল। আরিফুল এখন জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক।

নাজিফা জান্নাত ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ছিলেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক। তিনি এখন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ।

নাজিফা: বাংলাদেশের অনেক মানুষ দেশে থাকতে চান না। বিদেশ চলে যেতে চান। আমার চাওয়া, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হবে, মানুষ বলবে আমরা বাংলাদেশে গিয়ে থাকতে চাই।

কথোপকথন

তিনজনকে নিয়ে আমরা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পৌঁছাই ১১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে। তখন সেখানে ধোয়ামোছা ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছিল। স্মৃতিসৌধের সামনে বসে তাঁরা শুরু করলেন তাঁদের মধ্যে কথোপকথন।

বজলুল গনি: আমি আপনাদের আন্দোলনে শামিল ছিলাম। মানসিকভাবে। বয়স হয়ে গেছে, এখন ৮৫ বছর চলছে। শারীরিকভাবে আপনাদের লড়াইয়ে যোগ দিতে পারিনি। একটি জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে যুবসমাজ। আমাদের যুবসমাজ আমাদের অনুভূতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

নাজিফা: আমরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে শুনেছি। বই পড়ে জেনেছি। আপনি একজন বীর প্রতীক, সম্মুখসমরের যোদ্ধা। আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট কী ছিল?

বজলুল গনি: মানুষ যুদ্ধ স্বেচ্ছায় করতে চায় না। চাপিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তারা বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল, অন্যায় করেছিল, আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছিল; সেটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে।

সব শেষে তাঁরা ছবি তোলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের একটি স্মৃতিফলকের সামনে দাঁড়িয়ে। সেখানে লেখা ছিল, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।’

নাজিফা: আপনি (বজলুল গনি) তো পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।

বজলুল গনি: হ্যাঁ। আমি ছিলাম পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই।

আরিফুল: আপনি যদি পালিয়ে আসার কাহিনিটি আমাদের বলেন।

বজলুল গনি: পুরো কাহিনি প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত আমার শত্রুভূমি থেকে সম্মুখসমরে বইয়ে আছে। আমি তখন সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটের অ্যাডজুট্যান্ট ছিলাম। একদিন মেজর তাহের আমার কাছে এলেন। আমরা পরামর্শ করলাম, কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে থাকলে সেটা সম্ভব হবে না। তিনি বললেন, ‘চলেন আমরা পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি।’ আমাদের পালিয়ে আসার চেষ্টার সঙ্গে যোগ দেন মেজর মঞ্জুর ও মেজর জিয়াউদ্দিন। প্রথম দফায় আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় দফায় সফল হই।

নাজিফা: প্রথমবার ব্যর্থ হওয়ার পর কীভাবে পালিয়ে এলেন?

বজলুল গনি: ভারত সীমান্ত অনেক দূরে ছিল। আমরা একটি পুরোনো ফক্সভাগেন গাড়ি কিনলাম। দাম পড়েছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। কেনার পর সেটা মেরামত করলাম। একদিন রওনা দিলাম। বহু কষ্ট করে, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মধ্যে রাতে আমরা সীমান্ত পাড়ি দিতে পেরেছিলাম। পাড়ি দেওয়ার সময় কয়েক দফা ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। ভারতে ঢোকার পর ভোরে আমরা গ্রামবাসীর সহায়তায় বিএসএফকে খবর দিই। বিএসএফ আমাদের উদ্ধার করে। সেখান থেকে নিয়ে আমাদের রাখা হয় দিল্লির লোদি হোটেলে। সেখানে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সাত দিন পর পাঠানো হয় কলকাতায়। সেখান থেকে যাই যুদ্ধের ময়দানে। আমার দায়িত্ব পড়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালায়।

আরিফুল: আপনারা যুদ্ধ করলেন, দেশ স্বাধীন হলো। যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেটা কতটুকু পূরণ হয়েছে—অর্থনৈতিক মুক্তি, মানবিক মর্যাদা?

বজলুল গনি: সত্যিকারের মুক্তি এসেছে কি না, সন্দেহ হয়। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, সেই বৈষম্যের সমস্যার কথাই এখন আলোচনা হচ্ছে। যাঁরা মেধাশক্তিসম্পন্ন, তাঁরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। আমাদের যুবসমাজ এটার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলল। ইনশা আল্লাহ, আমরা আশা করি, এ ধরনের বৈষম্য থেকে দেশ মুক্ত থাকবে।

নাজিফা: আমরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য দেখেছি, অত্যাচার-নিপীড়ন দেখেছি। একাত্তরে সেটার বিরুদ্ধে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। চব্বিশেও বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে। আমাদের প্ল্যাটফর্মের নামই ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৫৩ বছর পরও আমাদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে।

বজলুল গনি: আপনারা তো সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেটা পরে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। আপনারা অ্যাডভাইস (পরামর্শ) কোথা থেকে পেয়েছিলেন?

আরিফুল: আসলে অ্যাডভাইস পাওয়ার বিষয় নয়। আমাদের আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তারা হত্যাকাণ্ড শুরু করল। নির্বিচার গুলি হলো। সাধারণ মানুষ, নারী, পুরুষ, শিশু মারা গেল। এমনকি ঘরে থেকেও মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো। এই মৃত্যু, এই রক্ত আমাদের এক দফায় নিয়ে যেতে বাধ্য করল।

বজলুল গনি: এই যে আপনি বললেন, সাধারণ মানুষ, নারী, পুরুষ, শিশু মারা গেছে। তার মানে, পুরো জাতি আপনাদের দাবির সঙ্গে ছিল।

আরিফুল: জি। ১৬ জুলাই (২০২৪) হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। ওই দিন ছয়জনকে মেরে ফেলা হয়। রংপুরে মেরে ফেলা হয় আবু সাঈদকে। পরে আরও অনেক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সরকারি বাহিনী পুরো শক্তি নিয়ে জনগণের বিপক্ষে নেমেছিল, সরকার জনগণকে যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ফলে অবস্থা দাঁড়িয়েছিল এই যে তিনি (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় থাকলে মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। এ কারণে আমাদের ৯ দফা দাবি এক দফায় রূপ নেয়।

বজলুল গনি: সেটা আন্দোলন আরও জোরদার করার জন্য?

আরিফুল: আমরা কিন্তু আগেই এক দফা দাবি তুলিনি। সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ১, ২ ও ৩ আগস্ট বিভিন্ন কর্মসূচিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক দফার দাবি তুলেছিল। শহীদ মিনারে যোগ দেওয়া লাখো মানুষ আঙুল তুলে এক দফার কথা বুঝিয়েছিলেন। এরপর যাঁরা আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন, তাঁরা এক দফা দাবি তুলে ধরেন। এমন ছিল যে এক দফা দাবি যদি কেউ ঘোষণা না করতেন, জনগণ তাঁকে রিজেক্ট (প্রত্যাখ্যান) করে এক দফার দিকে যেত। জনগণ নিজেই নিজেদের দায়িত্ব নিত।

বজলুল গনি: আপনারা কি মনে করেন, আপনাদের দাবি পূরণ হয়েছে?

নাজিফা: আমরা দেয়ালে লিখেছিলাম, স্বৈরাচারের দশ দিন, জনগণের এক দিন। আমাদের মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে ১৫ বছরের স্বৈরাচারের বিদায় হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের যে ৯ দফা দাবি ছিল, তা পূরণের রাস্তা খুলে গেছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের পর বিগত ৫৩ বছরে আমাদের দেশকে যেভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, সেভাবে না হওয়ায় আমাদের লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। আগের ব্যর্থতার ঘাটতি পূরণের সুযোগ এবার এসেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। এবার আমরা একটা বেটার (ভালো) বাংলাদেশের জন্য, স্বৈরাচারমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছি। তবে আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভিপ্রায় এখনো পূরণ হয়নি। আমরা গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁদের কথা মাথায় রেখে আমরা দেশকে এগিয়ে নিতে চাই।

আরিফুল: যে পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন, সেটার প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা আছি। মানুষের মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার শুধু গত ১৫ বছর নয়, ৫৩ বছরে নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সব নাগরিক, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে তার অধিকার নিশ্চিত করা—শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে। আমরা চাইব, আগামীর বাংলাদেশে একজন কৃষক, রিকশাচালক, গার্মেন্ট কর্মী; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সচিব—রাষ্ট্রের সেবার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য যেন না হয়। রাষ্ট্রীয় কোনো ক্ষেত্রে পরিচয় যেন বাধা না হয়, সেটা ধর্মীয় পরিচয় হোক, জাতিগত পরিচয় হোক অথবা পেশাগত পরিচয় হোক।

বজলুল গনি: তার মানে, সবার সমান অধিকারের কথা বলছেন। এটা কত দিনে অর্জিত হবে?

আরিফুল: রাষ্ট্রের সভ্য হয়ে ওঠা, জনগণের দায়িত্ব নেওয়া—এটা দীর্ঘমেয়াদি লড়াই। ধারাবাহিকভাবে সেটার জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। প্রথম কাজ হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ করা এবং সংস্কার দ্রুত করে নির্বাচন দেওয়া।

নাজিফা: বাংলাদেশের অনেক মানুষ দেশে থাকতে চান না। বিদেশ চলে যেতে চান। আমার চাওয়া, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হবে, মানুষ বলবে আমরা বাংলাদেশে গিয়ে থাকতে চাই।

বজলুল গনি: আমি একটু বলি, ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতেন। তাঁদের জন্য আলাদা হল ছিল। সেই অবস্থা আবার তৈরি করতে হবে। যাহোক, আপনাদের কাছে আমার শেষ প্রশ্ন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আপনারা কী পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখেন?

আরিফুল: এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ গৌরবের জায়গা মুক্তিযুদ্ধ। এর মাধ্যমে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল—অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার; তা কিন্তু ৫৩ বছরে শাসকগোষ্ঠী পূরণ করতে পারেনি। সে কারণেই চব্বিশে গণ-অভ্যুত্থান। এতে ২ হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন, ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের যে মূল তিন নীতি—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, সেটা অর্জনের জন্যই আমাদের গণ-অভ্যুত্থান। একাত্তর ও চব্বিশ মুখোমুখি কোনো বিষয় নয়। একাত্তরের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি বলেই আমাদের চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান করতে হয়েছে।

নাজিফা: আমার প্রত্যাশা, বাংলাদেশের সব ধর্মের মানুষ সমান মর্যাদা নিয়ে বাস করবেন। বাংলাদেশের মাটিতে নানা ধরনের দর্শনের চর্চা হয়; সুফিবাদ, লালনের দর্শন ইত্যাদি। আমি দর্শন ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন চাই। সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতা থাকবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশ এখন তরুণ, যাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট (জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ) বলা হয়। এটা দেশের শক্তির জায়গা হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা শুধু অদক্ষ কর্মীদের শ্রম দিতে বিদেশে পাঠাই। রপ্তানি শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আসলে অর্থনীতির ভিত্তি বাংলাদেশের মাটিতেই তৈরি করতে হবে। বাইরের কোনো শক্তির ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমি চাই, রাজনীতিবিদেরা জনগণকে মর্যাদার চোখে দেখবেন, রাজনীতিকে দায়িত্বের জায়গা থেকে দেখবেন। সেটা করেন না। এ কারণে আমাদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা যাঁরা গণ-অভ্যুত্থানে ছিলাম, সেই তরুণ প্রজন্মের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, রাজনীতিকে দায়িত্বের জায়গা থেকে দেখতে হবে এবং মানুষকে মর্যাদা দিতে হবে।

বজলুল গনি: মানুষের মানবাধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রতিবাদ জানানো ও দাবি আদায়ের অধিকার থাকলেই সব সম্ভব। কী বলেন আপনারা?

নাজিফা: মানুষ অত্যাচারিত হতে চায় না। মানুষ স্বাধীন থাকতে চায়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে যখন অত্যাচার ও বৈষম্য করা হয়েছে, তখন মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। এবারও বাংলাদেশের মানুষ বৈষম্য ও অন্যায় মেনে নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমরা সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল। আপনি (বজলুল গনি) একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আপনারা না থাকলে আমরা আজকে এখানে বসতে পারতাম না, আমাদের যোগসূত্র তৈরি হতো না। চব্বিশ আসলে একাত্তরের ধারাবাহিকতা। দুটিকে নিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

ঘণ্টা দেড়েক কথোপকথন শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের দুই সংগঠক এগিয়ে গেলেন স্মৃতিসৌধের দিকে। খালি পায়ে হাঁটলেন তাঁরা। একপর্যায়ে তাঁরা তিনজন একসঙ্গে স্যালুট জানান একাত্তরে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারীদের। সব শেষে তাঁরা ছবি তোলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধের একটি স্মৃতিফলকের সামনে দাঁড়িয়ে। সেখানে লেখা ছিল, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে/ বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা/ আমরা তোমাদের ভুলব না।’