চট্টগ্রামে বন্দর ব্যবসা আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের হাতের মুঠোয়
টানা ১৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসা সাত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতে আওয়ামী লীগ নেতা অথবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। আবার কোনোটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী।
কখনো এসব প্রতিষ্ঠান ‘নামকাওয়াস্তে’ ডাকা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। কখনো সরাসরি দরপত্র পদ্ধতিতে এই সাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কার্যত প্রতিযোগিতা না হওয়ায় বন্দরে কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বেশি হয়েছে। বাড়তি ব্যয় পণ্যের দামের ওপর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সাত প্রতিষ্ঠানের একটি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) ও স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড ও বশির আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানে মালিকানা রয়েছে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও তাঁর পরিবারের।
এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে মালিকানা ছিল আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও ফেনী-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন নাসিমের। এখনো মালিকানা আছে নাসিমের ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা ওয়াহিদ খানের।
বন্দরসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) ও স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
নোয়াখালী সদর আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর মালিকানা রয়েছে এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্সে। এফ কিউ খান অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু শরীফ। তাঁর তেমন কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ফজলীসন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে ইকরাম চৌধুরী চট্টগ্রামের প্রভাবশালী চৌধুরী পরিবারের সদস্য। ওই পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয় তিনটি টার্মিনালের ১২টি জেটির মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) চারটি জেটি এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের (সিসিটি) দুটি জেটির নিয়ন্ত্রণ করে সাইফ পাওয়ার টেকের হাতে। জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ছয়টি জেটি বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১৭ বছরে এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কনটেইনার ওঠানো-নামানোর বিনিময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা পায়। এই টাকার পরিমাণ কত হবে, তা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিক হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রতিযোগিতা হলে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ব্যয় অনেক কমে আসার সুযোগ তৈরি হয়। বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসায় বিনিয়োগ কম লাগে। নিশ্চিত মুনাফা বেশি। সরকারঘনিষ্ঠরা বেশি টাকায় কাজ নিয়েছেন। অর্থমূল্য দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্য কাউকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন গত ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বন্দরে এখন থেকে সব দরপত্র উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হবে। শর্ত এমনভাবে পর্যালোচনা হবে, যাতে ঘুরেফিরে একই প্রতিষ্ঠান কাজ না পায়। তিনি বলেন, বন্দরে অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনেক লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। সবই নজরে আছে।
কখনো এসব প্রতিষ্ঠান ‘নামকাওয়াস্তে’ ডাকা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। কখনো সরাসরি দরপত্র পদ্ধতিতে এই সাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে।
সাইফ পাওয়ারটেকের পেছনে আ.লীগ নেতারা
সাইফ পাওয়ারটেকের হাতে যে ছয়টি জেটি রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেই বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। ২০০৬ সালে বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজের হাতেখড়ি হয় সাইফ পাওয়ারটেকের। আওয়ামী লীগ আমলেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্মকর্তারা কীভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে বন্দরের কাজ পেতে সহযোগিতা করতেন, তার বড় উদাহরণ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা–সংক্রান্ত দরপত্র। বাংলাদেশে প্রথম বন্দরকেন্দ্রিক বিদেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল এই নিউমুরিং টার্মিনালে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে কাজ গুছিয়ে এনেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্রপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায় আরও ছয় বছর। ২০১৫ সালে টার্মিনালটির চার জেটিকে দুই প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দরপত্রের শর্ত এমনভাবে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া আর কেউ যোগ্য নির্বাচিত না হয়।
বন্দর সূত্রে আরও জানা গেছে, তখন একটি দরপত্রে আ জ ম নাছিরের প্রতিষ্ঠান এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড (৩০ শতাংশ) ও একরামুল করিম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্স (৩০ শতাংশ) অংশীদার করে সাইফ পাওয়ারটেক।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্রপ্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায় আরও ছয় বছর।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার দুটি কাজের চুক্তিমূল্য ছিল প্রায় ৯৯ কোটি টাকা। মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন ছাড়াই কাজ দেওয়া হয় সাইফ পাওয়ারটেককে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছিল। সূত্র বলছে, তবে তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বিষয়টি ‘ম্যানেজ’ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে নূর-ই-আলম চৌধুরী আত্মগোপনে চলে গেছেন। শাজাহান খান গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। তাই তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় আর কখনো দরপত্র ডাকা হয়নি। বরং সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে ছয় মাস মেয়াদে সাইফ পাওয়ারটেককে কাজ দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে ১১তম বারের মতো সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয়, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। সব মিলিয়ে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার কাজের চুক্তিমূল্য দাঁড়িয়েছে ৯০২ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করে কাজ দেওয়া হয়, দরপত্র হয় না।
এই অভিযোগ সত্য হলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সালমান এফ রহমানের হস্তক্ষেপে নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া কেন শুরু হয়েছিল?তরফদার রুহুল আমিন
একইভাবে গত ১৭ বছরে সমঝোতা, দরপত্র ও সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে প্রতিবারই চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের কাজ পেয়েছে সাইফ পাওয়ারটেক। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ছয় বছরের জন্য প্রায় ৩০৪ কোটি টাকায় টার্মিনালটি পরিচালনার কাজ পায় তারা। এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের নভেম্বরে।
সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দরপত্রের মাধ্যমে অনেক কাজ পেয়েছেন। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে দেওয়া কাজ তাঁরা করতে চান না। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বন্দরকে আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, যাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।’
আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে কাজ পাওয়া নিয়ে তরফদার রুহুল আমিন বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য হলে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সালমান এফ রহমানের হস্তক্ষেপে নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া কেন শুরু হয়েছিল?’
বন্দর সূত্র বলছে, সরকারি কাজে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ছিলেন একটি পক্ষের প্রভাবশালী ব্যক্তি। সেই পক্ষের বাইরে ছিলেন তরফদার রুহুল আমিন। তবে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে নূর-ই–আলম চৌধুরীর (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) সঙ্গে সখ্য রাখতেন।
আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কাছাকাছি যেতে চট্টগ্রাম আবাহনীর পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন তরফদার রুহুল আমিন। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম আবাহনীর ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হন তিনি। এক বছর পর শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনেও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তরফদার রুহুল আমিনের। পরে অবশ্য সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব নামে দলও গঠন করেছেন তিনি। সূত্র বলছে, ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাসচিব শামসুল হক চৌধুরী, যিনি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে ১১ বছর ধরে ঢাকার কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও কেরানীগঞ্জে চট্টগ্রাম বন্দরের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনা করে আসছে সাইফ পাওয়ারটেক।
শুধু মালিকানা নিয়েই ক্ষান্ত হননি তাঁরা, আমাদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। আমরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে থাকতাম।বশির আহমেদের বড় ভাইয়ের ছেলে মো. নুরুজ্জামান
নাছিরের দুই প্রতিষ্ঠান
দুই দশকের বেশি সময় আগে এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়ে বন্দরের ব্যবসায় যুক্ত হন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি সমঝোতার মাধ্যমে বন্দরে একটি জেটি পরিচালনার কাজ পায়। পরে দরপত্রের মাধ্যমে টানা ১৭ বছর ধরে একটি জেটি পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের পর আ জ ম নাছির উদ্দীনের নিয়ন্ত্রণে আসে কনটেইনার জেটি পরিচালনায় যুক্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান। সেটির নাম মেসার্স বশির আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড।
বশির আহমেদের স্বজনেরা বলছেন, কৌশলে এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় নিজের স্ত্রী শিরিন আকতারকে যুক্ত করেছেন আ জ ম নাছির। বশির আহমেদের বড় ভাইয়ের ছেলে মো. নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু মালিকানা নিয়েই ক্ষান্ত হননি তাঁরা, আমাদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। আমরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে থাকতাম।’
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আ জ ম নাছির আত্মগোপনে গেলে তাঁর পক্ষে ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেন মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন। তিনি মেসার্স বশির আহমেদ লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জোর করে মালিকানা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ নিয়ে মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তিও হয়েছে।
বন্দর ব্যবসায় নাসিমও
আওয়ামী লীগ আমলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমের পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এভারেস্ট এন্টারপ্রাইজে হঠাৎ মালিকানায় পরিবর্তন আসে। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড’ হিসেবে কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। তাতে প্রথমবারের মতো মালিকানায় নাম আসে আ জ ম নাছির উদ্দীন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও পরে ফেনী-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন নাসিম ও তাঁর ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর।
সূত্র বলছে, আলাউদ্দিন নাসিমের চাপে শাহাদাত হোসেন নিজ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা দেন এই দুই প্রভাবশালীকে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হলে নাছির ও নাসিম শেয়ার ছেড়ে দেন। তবে নাসিমের ভাই জালাল উদ্দিন চৌধুরীর নামে শেয়ার বেড়ে যায়। মালিকানায় যুক্ত হন জালালের স্ত্রী ফারজানা ওয়াহিদ খান।
বিষয়টি নিয়ে শাহাদাত হোসেন বিশেষ কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক সংকটে পড়ে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করেছিলেন তিনি। পাওনা শোধ করেছেন। শেয়ারের মালিকানা আবার ফেরত নিচ্ছেন। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেনারেল কার্গো বার্থের ছয়টি কনটেইনার জেটিতে একটি করে অপারেটর ও দুটি করে সহ-অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দরপত্র আহ্বান করা হলে সহ-অপারেটররা আর জেটি পরিচালনার সুযোগ পায়নি। সেই থেকে ছয়টি জেটিতে ছয়টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছে। প্রতিবার দরপত্রে সবাই এমনভাবে দর দিচ্ছে, যাতে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের দরের খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। প্রাক্কলিত দরের সঙ্গেও ব্যবধান বেশি থাকে না।
এখন যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তারাও যাতে আগের মতো ব্যবসা দখল করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবেসুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যোগ্য হয়েছে বলেই প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেয়েছে, রাজনৈতিক কারণে নয়।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব দরপত্র ছিল লোকদেখানো। সে কারণেই একই প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ পেত। দরপত্রের শর্ত ওই সব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হতো।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ঠিকাদারি কাজে একটা সিন্ডিকেট (চক্র) তৈরি হয়েছে, যারা বছরের পর বছর কাজ পেয়ে আসছে। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর স্বচ্ছতা আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বন্দরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
আখতার কবির বলেন, ‘এখন যে সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, তারাও যাতে আগের মতো ব্যবসা দখল করতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’