করোনাভাইরাস সংক্রমণের ধাক্কা সামলে নিয়ে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রবৃদ্ধির দিকে এগোতে শুরু করেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেনকে যুদ্ধকে ঘিরে সারা বিশ্বে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ২০২৩ সালের প্রবৃদ্ধি একেবারেই অনিশ্চিত। এমন এক প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হলে অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে সিঙ্গাপুরের একটি কনভেনশন সেন্টারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে শুরু হওয়া চার দিনের আঞ্চলিক বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তারা এ মন্তব্য করেন। ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বক্তারা।
আঞ্চলিক এ বৈঠকে সিঙ্গাপুর, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ভারত, বাংলাদেশসহ ১৯টি দেশের শ্রমমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা অংশ নিচ্ছেন। আর সব মিলিয়ে সরকারের পাশাপাশি মালিক, শ্রমিকসহ ৩৩টি দেশের প্রায় ৫০০ প্রতিনিধি আলোচনায় যোগ দিয়েছেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট হালিমাহ ইয়াকুব বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির যে ধারণা আমাদের সামনে আছে, করোনা মহামারির পর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা ওই মডেল নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। সামনে যে চ্যালেঞ্জ আছে, তা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনার খোরাক জোগাবে আইএলওর আঞ্চলিক এ বৈঠক। একটি ন্যায়সংগত এবং অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধি, যেখানে সবারই ভূমিকা আছে, সেটি নিশ্চিত করতে আইএলওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’
কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট। হালিমাহ ইয়াকুব বলেন, সিঙ্গাপুর দ্রুততার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকদের উদ্বেগগুলো কীভাবে দূর করেছে, তা জানতে চাইলে বলব, সরকার, মালিক ও শ্রমিককে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় যে প্রক্রিয়া, তার ওপর আমাদের ব্যাপক আস্থা রয়েছে। তিনটি পক্ষ মিলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল ঠিক করে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে।’
সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্টের মতে, বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজি অবাধে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারে। চরম প্রতিযোগিতা সামাল দিতে গিয়ে ব্যাপক কাটছাঁটের কারণে শ্রমিকের মজুরি কমে যাওয়ার পাশাপাশি তাঁদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আইএলওর মহাপরিচালক গিলবার্ট হংবো তাঁর বক্তৃতায় করোনাভাইরাসের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট এবং জলবায়ুর পরিবর্তন শ্রমিকের সামাজিক সুরক্ষাকে বিঘ্নিত করেছে, সে বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি অবহেলিত। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় শ্রমমান, কর্মসংস্থানের নীতিমালা ও সামাজিক সুরক্ষা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গিলবার্ট হংবো আরও বলেন, ‘আমরা চাই, ভবিষ্যতের স্বার্থে মানুষকে ঘিরে যে প্রবৃদ্ধি, তাতে সবার সমান সুযোগ–অধিকার থাকুক। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগের সময়ের চেয়ে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্মসংস্থান পরিস্থিতির আংশিক উন্নতি হয়েছে। এ হার সন্তোষজনক হলেও ২০২৩ সালে বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমবাজার পুরোপুরি সামলে উঠবে কি না, এখনো সেটা অনিশ্চিত।’
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাশাপাশি আরব বিশ্বের দেশগুলোর শ্রমবাজারে কাঠামোগত দুর্বলতা থেকে যাওয়ার কারণে মর্যাদাপূর্ণ ও ন্যায়সংগত প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন গিলবার্ট হংবো। তিনি বলেন, দুটি অঞ্চলেই নারী-পুরুষের বৈষম্য বিলোপে একেবারেই সীমিত অগ্রগতি, সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি, বিপুলসংখ্যক তরুণের বেকারত্ব এবং বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমে যুক্ত থাকার মতো সমস্যাগুলো রয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মর্যাদাপূর্ণ কাজ নিশ্চিত করতে হলে এসব সমস্যা দূর করা জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইএলওর মহাপরিচালক করোনাভাইরাসের সংকট মোকাবিলায় সদস্যদেশগুলোর ভূমিকার প্রশংসা করেন। গিলবার্ট হংবো বলেন, ‘আমরা মহামারির সময় লক্ষ করেছি, যেসব দেশের শ্রমবাজার–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী, তারা দক্ষতার পাশাপাশি কার্যকরভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পর্বে আইএলওর সদস্যদেশগুলো বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, তা তিনি স্বীকার করেন। এ কারণে সদস্যদেশগুলোর জন্য বাড়তি আর্থিক জোগান দেওয়া দুরূহ বটে।
চার দিনের আঞ্চলিক বৈঠকের সভাপতি এবং সিঙ্গাপুরের কর্মসংস্থানমন্ত্রী সি ল্যাং টান বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা ও সামাজিক আলোচনার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে সিঙ্গাপুর পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল। তিনি জানান, ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে সিঙ্গাপুর সেই সময় কাজের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি কর্মী ছাঁটাই যাতে যুক্তিসংগত হয়ে, সেটি নিশ্চিত করা, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিককে সমর্থন দেওয়া এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির সম্প্রসারণ করেছিল।
উদ্বোধনী অধিবেশনে মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে জাপানের হিরোইয়োকি মাতসুই এবং শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে ফিজির ফ্যালিক্স অ্যান্টনি বক্তব্য দেন।