দ্রুতগতি ও অবহেলার খেসারত

চালক সুপারভাইজারের সঙ্গে ও মুঠোফোনে অনবরত কথা বলছিলেন বলে অভিযোগ। ১৭ জন নিহত, আহত ৩৪। পাঁচ জেলায় নিহত আরও ৭।

সালমা নামের এক নারী বাসে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশাল যাচ্ছিলেন। ঝালকাঠির ছত্রাকান্দা এলাকায় বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে গেলে তিনি নিহত হন। ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে লাশ নিতে এসে ছোট বোনের আহাজারি। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায়
ছবি: সাইয়ান

অতিরিক্ত গতি ও চালকের অবহেলা-অমনোযোগিতার কারণেই পুকুরে পড়েছে বাসটি। ঘটেছে এমন মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা। অন্তত ১৭ যাত্রী নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হয়েছেন ৩৪ জন। ঝালকাঠির ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রীদের বয়ানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন পুকুরে ‘বাশার স্মৃতি’ নামের ওই বাস পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে আহত বাসযাত্রী পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার ভূমি অফিসের কর্মচারী মিজানুর রহমান (৫২) অভিযোগ করে বলেন, ৪০ আসনের বাসটি সকাল পৌনে নয়টায় ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী ওঠানোর ফলে যাত্রীসংখ্যা প্রায় ৭০ জন হয়। ছাদেও কয়েকজন যাত্রী ছিল। বাসটি দ্রুতগতিতে ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় অতিক্রম করার সময় চালক মোহন মিয়া সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি সড়কের বাঁ দিকে পুকুরে পড়ে যায়।

একই ধরনের অভিযোগ করেন দুর্ঘটনায় বাবা ও এক ভাইকে হারানো আহত মো. রাসেল মোল্লা (৩৫)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি চালকের পেছনের আসনে ছিলেন। চালক যাত্রার শুরু থেকেই গাড়িতে যাত্রী ওঠানোর জন্য বারবার সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। গাড়ি চালনায় তাঁর মনোযোগ ছিল না।

বাস চালানোর সময় চালক মুঠোফোনেও কথা বলছিলেন বলে অভিযোগ করেন কয়েকজন।

হঠাৎ শব্দ শুনে বের হয়ে দেখি বাসটি পুকুরে পড়ে গেছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে যারা ছিল এবং আশপাশের লোকজন ছুটে এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে লোকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে
ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাদ আবুল কালাম

দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ জন হলেন পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া পৌর এলাকার তারেক রহমান (৪৫), সালাম মোল্লা (৬০), তাঁর ছেলে শাহীন মোল্লা (২৫), সাদিয়া বেগম (২০), পশুরবুনিয়া এলাকার জালাল হাওলাদারের মেয়ে সুমাইয়া (৬), রিজার্ভ পুকুরের পাড় এলাকার রহিমা বেগম (৬০), তাঁর ছেলে আবুল কালাম হাওলাদার (৪৫), উত্তর শিয়ালকাঠি এলাকার রাবেয়া বেগম (৮০); ঝালকাঠির রাজাপুরের নিজামিয়া এলাকার খাদিজা বেগম (৪৩), তাঁর মেয়ে খুশবু আক্তার (১৭), দক্ষিণ রাজাপুরের বলাইবাড়ি এলাকার মো. নয়ন (১৬), কাঁঠালিয়ার বাঁশবুনিয়া গ্রামের সালমা আক্তার (৪২), শৌলজালিয়া এলাকার ফারুক হোসন (৫৫); বরিশালের বাকেরগঞ্জের চরবোয়ালিয়া

গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ (৮), মেহেন্দীগঞ্জের আইরিন আক্তার (২২), তাঁর মেয়ে রিপা মণি (২) ও বরিশাল সদরের পারভীন আক্তার (২০)। এদিকে দুর্ঘটনায় এত আহত রোগীর উপস্থিতিতে শয্যাসংকট দেখা দেয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। এতে অনেককে মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন কাঁঠালিয়ার আবুল বাশার, রিজিয়া, ভান্ডারিয়ার রাসেল মোল্লা, ফাতিমা, রাসেল, মনিরুজ্জামান, ঝালকাঠির নলছিটির মিফতা, আজিজুল, রিজিয়া, আরজু, রাজাপুরের মনোয়ারা, সোহেল, আলাউদ্দিন, আবুল কালাম, ভোলার সুইটি, পটুয়াখালীর বাউফলের রুকাইয়া, সিদ্দিকুর, বরগুনার আকাশ, সাতক্ষীরার সোহাগ, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার নাঈমুল, ঝালকাঠির আল-আমিন, বরিশালের সাব্বির। এ ছাড়া দুজনকে বরিশাল শের-ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

জেলা সিভিল সার্জন এইচ এম জহিরুল ইসলাম বলেন, আহত ব্যক্তিদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেককে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে।

বাসটি পুকুরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা উদ্ধারকাজে ছুটে আসেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজাদ আবুল কালাম। ঘটনার সময় তিনি পরিষদের কার্যালয়ে ইউপি সদস্যদের নিয়ে সভা করছিলেন।

আজাদ আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ শব্দ শুনে বের হয়ে দেখি বাসটি পুকুরে পড়ে গেছে। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে যারা ছিল এবং আশপাশের লোকজন ছুটে এসে পুকুরে ঝাঁপিয়ে লোকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।’ তাঁর কথায়, স্থানীয় লোকজন তাৎক্ষণিক তৎপর না হলে প্রাণহানি বাড়তে পারত।

উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে আহত হওয়া ইউপি সদস্য ফয়সাল রহমান বলেন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস পৌঁছার আগেই তাঁরা ৫০-৬০ জন মিলে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।

ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে তাঁদের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন।

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. মামুন শিবলীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষ থেকে লাশ দাফন ও পরিবহনের জন্য নিহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে মোট ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক বলেন, দুর্ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হবে।

পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বাসটি বেলা দেড়টার দিকে রেকার দিয়ে টেনে ওপরে তোলা হয়েছে। পুকুরে আর কারও মরদেহ নেই।

ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মু. নাসির উদ্দিন বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত বাসের চালক ও সুপারভাইজারের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে চালকের সহকারীকে আহত অবস্থায় (১৭) পাওয়া গেছে।

পাঁচ জেলায় নিহত ৭

পাঁচ জেলায় শুক্রবার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে গতকাল সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন সিএনজিচালিত অটোরিকশার দুই যাত্রী ফাতেমা বেগম (৪২) ও হেলাল (৩৫)। একই দিন সন্ধ্যায় শিবগঞ্জ উপজেলার ভাঙ্গাব্রিজ এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হন পথচারী আব্দুল আলিম (৫৫)।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার পেদিয়াগছ এলাকায় গতকাল দুপুরে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় নিহত হয় শিশু আব্দুল কাদের জিলানী (৮)। ঘটনার সময় সে বাড়ির সামনে ছয় মাস বয়সী বোনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দুর্ঘটনায় বোনও আহত হয়েছে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার মালিগ্রাম এলাকায় গতকাল দুপুরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের রেলিংয়ে ধাক্কা লেগে বাস উল্টে নিহত হন সুপারভাইজার খলিলুর রহমান সরদার (৪০)। আহত হন ১০ যাত্রী।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া পৌর শহরের উছলাপাড়া এলাকায় শুক্রবার রাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ধাক্কায় নিহত হন পথচারী মহসিন আহমদ (৪০)।

এ ছাড়া নীলফামারীর জলঢাকায় গতকাল দুপুরে জিন্নার স্কুল নামক স্থানে মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিহত হন সোহেল রানা (১৫)।