চুপ!
আমি এখন আমার পঞ্চম উপন্যাসের কাজ করছি। সেখানে বিশাল ধ্বংস ও বিনাশের কিছু দৃশ্য আছে। সামগ্রিক ধ্বংসের সাহিত্যিক রূপায়ন কী করে করতে হয়, তার বড় কিছু উদাহরণ রয়েছে বলকান অঞ্চল নিয়ে কাজ করা লেখকদের লেখায়, যেমন নোবেলজয়ী ইভো আন্দ্রিচে, পিটার হান্টকেতে আর জোসেফ রথে। নিজের উপন্যাসের স্বার্থে ব্যাপারটা একটু দেখে নিতে মন চাইলে হাতে নিলাম রথের বিশ্বখ্যাত ‘রাদেজকি মার্চ’। ওই উপন্যাস ফন ট্রট্টা রাজবংশের বিলুপ্তির গল্প, সেই সঙ্গে পুরো সমাজের শেষ হয়ে যাওয়ারও কাহিনি। পড়লে পরিষ্কার হবে যে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান এমপায়ার নামের বিদঘুটে জিনিসটার আদতে টেকারই কথা ছিল না কোনোদিন, কারণ, ওরকম জগাখিচুড়ি কোনো ভৌগোলিক ঐক্য পৃথিবীতে থাকাটা অসম্ভব, ওভাবে টেকে না কিছু।
১৯৪৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদেরকে এক করে দেখাটাও টেকেনি বেশি দিন। কারণ ছিল দুয়ের ভৌগোলিক দূরত্ব আর ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, সমাজের গঠন আলাদা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, অতএব হতেই হলো। ওই মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি, কারণ, আমার বয়স তখন মাত্র দুই চলে। কিন্তু সে একই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাকে ‘শর্তহীন মোহগ্রস্ত’ করে রেখেছিল শিক্ষাজীবনের প্রায় পুরো একটা দশক।
‘রাদেজকি মার্চ’-এর শেষ দিকে তৃতীয় প্রজন্মের লেফটেন্যান্ট ফন ট্রট্টাকে আমরা দেখি সাম্রাজ্য নিয়ে সে পুরো মোহমুক্ত। দাদা ব্যারন ট্রট্টার ইনফ্যানট্রি ইউনিট যে সুন্দর পেশাদার নিষ্ঠুরতার সঙ্গে একটা শ্রমিক আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেয়, তার বিভীষিকা দেখে সে বুঝে গেছে, এই ‘জাতীয় ঐক্য’ আর টিকবে না। সে বুঝে গেছে, তথাকথিত এই ঐক্যের মধ্যে ‘একের সঙ্গে অন্যের বিভেদ খুব বেশি...আরও বেশি নিষ্ঠুরতা...আরও বেশি সাধারণ লোকগুলোর বেঁচে থাকার সংগ্রামের প্রতি উপহাস ও অবজ্ঞা।’
মোহমুক্তির গল্প এখানে কেন বলছি? কিংবা ধ্বংসের কথা দিয়ে কেন শুরু হলো আমার এ লেখা? না, মুক্তিযুদ্ধের ওপর শ্রদ্ধা হারাইনি আমি, কিংবা সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এমনটাও মনে করি না যে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তারিখে নতুন দেশের সংবিধান যখন লেখা হলো, লেখা হলো ‘আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম’, আর সেই লেখার ওপর যখন দেখি যে জ্বলজ্বল করছে কিছু লাইন: ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে...এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সম্পদের প্রতিষ্ঠা ‘করব আমরা, যেখানে ‘সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’, তখন আমার উদ্বেগে-ভয়ে গা কেঁপে ওঠে।
কীভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছি আমরা! কীভাবে ওই লাইনগুলোর সঙ্গে আজকের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মেলালে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’-র আভাসটুকুও আজ আর কোথাও নেই! এর নাম কি মোহভঙ্গ হওয়া, নাকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘শর্তহীন মোহগ্রস্ত’ আর না থাকা?
আহা, কী হওয়ার ছিল আর কোথায় আছে এই দেশ! জাতীয়তাবাদের গোঁড়ার যে কথা দেশপ্রেম, তা এখন কোথায়? গত পাঁচ দশকে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এক জিডিপির ৪৬০ বিলিয়ন ডলার হয়ে ওঠার গল্প মিথ্যা নয়। কিন্তু এই সমৃদ্ধিই আবার পরিষ্কার দুভাগে ভাগ করে দিয়েছে ১৭ কোটি মানুষকে—এক দিকে ২ শতাংশ ক্ষমতাবানেরা, অপর দিকে ৯৮ শতাংশ ক্ষমতাহীন গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত জনগণ। অর্থনৈতিক বৈষম্য মাপার মূল মাপকাঠি যে জিনি কোএফিশিয়েন্ট, সেটা মুক্তিযুদ্ধের পরপর ছিল ১০০-তে ৩৬, এই গত নব্বইয়ের দশকের শুরুতেও ৩৯, আর ২০১৬-তে এসে ৪৮ দশমিক ২, এবং তার ৬ বছর পর এখন নিশ্চিত ৫০-এর ওপর।
জিওরজিও বাসসানির লেখা ১৯৬২ সালের ইতালিয়ান ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘দ্য গার্ডেন অব দ্য ফিনজি কনতিনিস ‘-এ ইতালিয়ান পরিসংখ্যানবিদ কোররাদো জিনি-র এই বৈষম্য মাপার তত্ত্ব ধরে বলা আছে, ‘এখনো জানো না, আজও জানো না কোথায় বাস করছ? ইহুদির জীবন আর খ্রিস্টানের জীবনের মান মাপার কোনো তুলনামূলক মাপকাঠি নেই।...কিন্তু জিনির মান ৫০ ছাড়ালে বুঝবা আছো দান্তের নরকে, আর ৬০ ছাড়ালে আছো হাবিয়া দোজখে।’
পরিসংখ্যান বাদই দিন। একেক সংস্থার নম্বর এ দেশে একেক রকম, যেমন বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার। তাই নিজের চোখ–কান দিয়েই দেখে বুঝে নিন কোন দোজখে আছেন। দোজখের চেহারাটা এ রকম: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালে প্রকাশিত হওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ পরিবারের, মানে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ মানুষের, মাসে গড় আয় মাত্র ৭৪৬ টাকা। আর সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের (২০ থেকে ২২ লাখ পরিবার) মাসিক আয় অনুমান করার সাধ্যও এখন আর আপনার নেই।
চারদিকে এখন শুধু লুটতরাজের গল্প, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে অবৈধ পাচার হওয়ার গল্প, প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের গল্প, আর লেখক পরিচয়ের পাশাপাশি পেশায় আমি ব্যাংকার বলেই আমার বলতে ইচ্ছা করে খেলাপি ঋণের গল্পটাও।
এই গল্প যে কী করে ১৯৯০ সালের মাত্র ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন হয়ে গেল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। বলতে ইচ্ছা করে বিদেশে টাকা পাচারের গল্পটাও যে বছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ও ২৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স আয় মিলে আমাদের ৭৭ বিলিয়ন ডলারের যে বার্ষিক আয়, তা কী করে আরও ৮ বিলিয়ন ডলার (পাচার হয়ে যাওয়া ওই ৭৫ হাজার কোটি টাকা) যোগ হয়ে হতে পারত ৮৫ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু সে হয়ে যাচ্ছে ৭৭ বিয়োগ ৮ অর্থাৎ ৬৯ বিলিয়ন ডলার! এটা দেশের ব্যালেন্স শিটের সাপেক্ষে বলা অঙ্কের কথা।
দেশ যা কিছু থেকে বঞ্চিত হয়, যেমন প্রতিবছর সে বঞ্চিত হচ্ছে ওই ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে, তা দেশের ব্যালেন্স শিটেই ঘুরেফিরে প্রতিফলিত হতে বাধ্য। কিন্তু এত কথা বলার জায়গা যে এখানে নেই!
তাই অল্প কিছু বলি। এ সময় দরকার ছিল শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, যা আজও মোট বাজেটের ২ শতাংশের মতো। বলা হয়ে থাকে শিক্ষায় ৪ শতাংশের কম ব্যয় করে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। সিইওওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন ২০২০ সালে বিশ্বের সেরা শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে যে তালিকা বের করেছিল, সেখানে ভারত ছিল ৩৩ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৭৭, পাকিস্তান ৮৩, এমনকি মিয়ানমারও ৯২-এ। কিন্তু ওই তালিকায় বাংলাদেশের নামই ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থা শেষ করে দিয়ে আমরা কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেখভাল করব?
ওদিকে বৈশ্বিক ক্ষুদা সূচকে বাংলাদেশ গত বছর থেকে এ বছর আট ধাপ পিছিয়েছে। আগের বছর আমরা ছিলাম ৭৬ নম্বরে, আর এ বছর ঠেকেছি ৮৪-তে এসে।
২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক বলেছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার চার প্রধান কারণ—শিল্পোৎপাদন, নির্মাণ খাত, শস্যের উচ্চফলন ও রেমিট্যান্স আয়। এর লেজে লেজেই অক্সফাম দেড় হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে জরিপ চালিয়ে দেখাল, টানা ওভারটাইম করার পরও এ দেশের ১০০ পোশাকশ্রমিকের মধ্যে ৯৮ জনই বেঁচে থাকার ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না এবং তাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনেরই তিন বেলা খাওয়ার সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে গত ১৩ বছরে কফিন চেপে দেশে ফিরেছে ৩৩ হাজার তরুণ ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’।
মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো শ্রীলঙ্কা বন্ধ করেছিল সেই ২০১৩ সালেই। আর আমাদের এখানে ভাঙা হাত-পা, ছ্যাঁকা খাওয়া শরীর ও ধর্ষণের ক্ষত গায়ে ও আত্মায় নিয়ে গত দেড়-দু বছরে শুধু সৌদি আরব থেকেই দেশে ফিরেছেন হাজার জন ‘রেমিট্যান্স নারীযোদ্ধা’। নির্মাণ খাতে বছরে মৃত্যু হচ্ছে শতাধিক শ্রমিকের-বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, বহুতল দালান থেকে পড়ে গিয়ে ইত্যাদি। কেন? কারণ, সামান্য একটা হেলমেট, একটা সেফটি বেল্ট তাদের মেলে না, ঠিক যেমন লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করা কৃষকের সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলোয় গিয়েও মেলে না ন্যায়বিচার। উল্টো সরকারি ওই কেন্দ্রগুলো তাদের কাছ থেকে ধান কেনে ফড়িয়া-মজুতদারদের দেওয়া দামের চেয়েও মণপ্রতি ১০০ টাকা কম দামে। ‘বাম্পার কৃষি’-র এই দেশে বছরের পর বছর ১৭ কোটি মানুষকে খাইয়ে যাওয়া কৃষকের ধানটুকু কেনা যায় না মণপ্রতি ৫০০ টাকায়?
বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের উন্নয়নকে রওনক জাহান ডেকেছেন ‘উন্নয়ন বিভ্রম’ নামে। আমার নিজের বিভ্রমটা ঘটেছিল প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’ লেখার সময়। সেটাতে আছে ঢাকার আশপাশে সন্তানেরা চরম দারিদ্র্যের থাবার সামনে দাঁড়িয়ে কী করে তাদের বৃদ্ধা মাকে পেটায়, সেই গল্প। জন্মদাত্রীকে পেটানো ওই পুত্রদের বিষয়ে জোগাড় করা প্রচুর তথ্য-উপাত্ত এখন আবারও দেখলাম এক ঝলক।
আবার ভয়ে গা কেঁপে উঠল আমার। আপনার মধ্যে ইতিবাচক ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ জাগিয়ে তোলার জন্য এ মুহূর্তে এসব নেতিবাচক কথা বলা ছাড়া অন্য কোনো কথা আমি বলতে পারছি না। আর বলবই বা কীভাবে? রাজনৈতিক অধিকার চর্চা, বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি সূচকে ‘ফ্রিডম হাউস’-এর ২০২১ সালের সবশেষ প্রতিবেদন মোতাবেক আমরা পড়েছি ‘আংশিক স্বাধীন’ ক্যাটাগরির দেশে আর সেই তালিকার ৫৯টা দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান নিচ থেকে ৭ নম্বর। অতএব-চুপ!
মাসরুর আরেফিন: কথাসাহিত্যিক; সিটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী।