ভৃত্য থেকে রানির বন্ধু
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন তার সাফল্যের চূড়ায় ছিল, তখন রানি ভিক্টোরিয়ার রাজদরবারের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন এক ভারতীয়। দৃশ্যপটে তাঁর আগমন হয়েছিল একজন ভৃত্য হিসেবে, কিন্তু রানি তাঁকে এতটাই পছন্দ করে ফেলেন যে তাঁকে নিজের শিক্ষক ও ভারতীয় সচিব হিসেবে নিযুক্ত করেন। তাঁর প্রতিপত্তি দেখে একবার রানির ভ্রমণের সময় সবাই ভেবে নিয়েছিল, তিনি বোধ হয় কোনো রাজকুমার। রানি ভিক্টোরিয়ার শেষ জীবনের এই পরম বন্ধুটির নাম আবদুল করিম।
সদ্য প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের আগে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে রাজত্বের রেকর্ডটি ছিল তাঁরই বৃদ্ধ প্রপিতামহী (দাদার দাদি) রানি ভিক্টোরিয়ার। ৬৩ বছর ধরে তিনি ব্রিটেনের রানি ছিলেন।
১৮৭৬ সালে ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ হন রানি ভিক্টোরিয়া। শুরু থেকেই তিনি ভারত নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। চার হাজার মাইলের বেশি দূরত্বের এই ব্রিটিশ উপনিবেশটি ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। তখনো মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেনি। ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর দুই বছর পর প্রথম বিমানটি আকাশে উড়েছিল। বয়সের কারণেই সমুদ্রপথে এত দূরের একটি দেশে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
১৮৮৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার ৫০ বছর পূর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে আগ্রা থেকে দুজন ভারতীয়কে ভৃত্য হিসেবে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তারই একজন ছিলেন আবদুল করিম।
আবদুলের বিলেতযাত্রা
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের ভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে তুলে নেয়। রানি ভিক্টোরিয়া আর ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতেন ভাইসরয়।
আবদুল করিমের পরিবার চার দশক ধরে আগ্রায় বাস করছিল। সেখানেই তাঁর জন্ম, ১৮৬৩ সালে। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়াকে যখন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরেইলি ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ ঘোষণা করলেন, তখন আবদুলের বয়স মাত্র ১৩।
আবদুল করিমের বাবা হাজি ওয়াজিরউদ্দিন ছিলেন হাসপাতাল সহকারী। ১৮৭৮ সালে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদলের সঙ্গে তিনি আফগানিস্তান গিয়েছিলেন। ১৭ বছরের আবদুলও বাবার সঙ্গে রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। এরপর একসময় ওয়াজিরউদ্দিন আগ্রার কেন্দ্রীয় কারাগারে চিকিৎসা সহকারী হিসেবে যোগ দেন। বাবার সঙ্গে ছেলে আবদুলও আগ্রা জেলে যোগ দেন একজন করণিক হিসেবে। তাঁর কাজ ছিল মূলত দাপ্তরিক, জেলের বন্দীদের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করে লিপিবদ্ধ করা।
কারাধ্যক্ষ জন টাইলার ১৮৮৬ সালে লন্ডনে যান সেখানকার কলোনিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান এক্সিবিশনে যোগ দিতে। সেখানে প্রদর্শিত আগ্রার কারাবন্দীদের তৈরি করা কার্পেটের কাজ দেখে রানি ভিক্টোরিয়া প্রশংসা করেন। আবদুলই এই কার্পেট বাছাইয়ের কাজে টাইলারকে সহযোগিতা করেছিলেন। আবদুল রানির জন্য একজোড়া সোনার চুড়িও পছন্দ করে দিয়েছিলেন।
পরের বছরই রানির সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। সে সময় ভারত থেকে বিভিন্ন রাজ্যের রাজঘরানার প্রতিনিধি, যাঁরা সিপাহি বিদ্রোহ দমাতে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। রানির ইচ্ছা, এ সময় কিছু ভারতীয় ভৃত্যকেও ব্রিটেনে নেওয়া হোক।
ভারতে ফিরে টাইলার ভাবলেন, আবদুল এ কাজের জন্য যথার্থ। যদিও টাইলার আবদুলকে বলেছিলেন, তিনি রানির চাপরাসি হিসেবে কাজ করবেন। রানির সহচর হওয়ার সম্মানের কথা ভেবে আবদুল রাজি হয়ে যান।
ব্রিটেন-যাত্রার আগে আবদুল করিমকে ব্রিটিশ রাজঘরানার আদবকেতা সম্পর্কে শেখানো হয়—কীভাবে রানির সামনে যেতে হবে, অভিবাদন জানাতে হবে, মাথা নিচু করে কীভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ইত্যাদি। তাঁকে বলা হয়, রানির চোখে চোখ রেখে তাকানো যাবে না, দৃষ্টি থাকবে রানির পায়ের দিকে। আবদুলকে রানির তিনটি রাজবাসভবন সম্পর্কে জানানো হয়—উইন্ডসর ক্যাসল, বালমোরাল ক্যাসল ও অসবর্ন হাউস। বাকিংহাম প্যালেসে রানি ভিক্টোরিয়া কদাচিৎ থাকেন, মূলত ব্যবহৃত হয় রাজকীয় আনুষ্ঠানিক কোনো কাজে। এ ছাড়া আবদুল করিমকে কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও শেখানো হয়।
যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আবদুলের জন্য বিশেষ এক সেট পোশাক বানানো হয়। আবদুল তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে কিছু রান্নাও শিখে নেন। নিজের ঝোলায় ভরে নেন কিছু মসলা। ১৮৮৭ সালের ২০ মে আবদুল করিম, মোহাম্মদ বকশ ও জন টাইলার ‘ক্যাথে’ নামক সমুদ্রগামী জাহাজে চড়ে ব্রিটেনের উদ্দেশে রওনা দেন।
রানির সুবর্ণজয়ন্তী
উৎসব শুরুর তিন দিন আগে আবদুল করিম ও মোহাম্মদ বকশ পৌঁছান উইন্ডসর ক্যাসলে। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত থেকে ১২ জনের একটি সৈন্যদলও এসেছিল। ‘ভারতসম্রাজ্ঞী’ হিসেবে তাঁর প্রভাব তিনি উৎসবে আমন্ত্রিত ইউরোপের অন্যান্য রাজপরিবারকে দেখাতে চেয়েছিলেন।
পরদিন জন টাইলার, আবদুল করিম ও মোহাম্মদ বকশ খাবারঘরের পাশে অপেক্ষা করছিলেন রানির জন্য। রানি আসার সঙ্গে সঙ্গে টাইলার হাঁটু মুড়ে রানির প্রতি সম্মান জানান। আবদুলও রানিকে সালাম দেন। এরপর আবদুল নিজের হাতের তালুতে ভারতবাসীর পক্ষ থেকে একটি সোনার মোহর রানিকে উপহার দেন। ভিক্টোরিয়া সেটিকে ছুঁয়ে টাইলারের সঙ্গে কথা বলতে চলে যান। এটাই ছিল রানির সঙ্গে আবদুলের প্রথম সাক্ষাৎ। দিনটি ছিল ১৮ জুন ১৮৮৭।
সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব চলে দুদিন ধরে—২০ ও ২১ জুন। প্রথম দিন যখন রানি শোভাযাত্রার জন্য বের হন, তখন তাঁর বাহনের সামনে ছিল ভারতীয় সৈন্যদল। এই প্রথম ব্রিটিশ জনতা পাগড়ি পরা ভারতীয় অফিসারদের দেখল। আবদুল ভেবেছিলেন, তিনিও এ সময় রানির সহচর হবেন। কিন্তু টাইলার বলেন, তাঁকে পরে সুযোগ দেওয়া হবে।
উৎসব উপলক্ষে ব্রিটেনে এসেছিলেন কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ, রানি সুনীতি দেবী, বরোদার রাজা সায়াজি রাও গায়কোয়াড়, রানি চিমনাবাই, ইন্দোরের রাজা শিবাজি রাও হলকার, ভরতপুরের রাজা যশবন্ত সিং, গোন্ডালের রাজা ভগবতসিংজি, লিমরির ঠাকুর যশবন্তসিংজি ফতেহসিংজি, মোরভির ঠাকুর লুখদিরজি বাহাদুর, যোধপুর-রাজার ভাই প্রতাব সিংসহ ভারতের আরও কিছু রাজঘরানার প্রতিনিধি। রানি ভিক্টোরিয়া সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পরদিন হাইড পার্কে ৩০ হাজার গরিব স্কুলশিক্ষার্থী রানির সম্মানে গায় ‘গড সেভ দ্য কুইন’ গানটি। রানির সম্মানে হয়েছিল আরও নানা আয়োজন—সংগীত-নৃত্যের আসর, পার্টি, নৈশভোজ।
সে সময় রানি ভিক্টোরিয়াকে বলা হতো ‘গ্র্যান্ডমাদার অব ইউরোপ’। বয়সের কারণে নয়, আক্ষরিক অর্থেই তিনি ইউরোপের দাদি ছিলেন। নিজের আট সন্তান ও কয়েকজন নাতি-নাতনিকে ইউরোপের নানা রাজ্যের রাজঘরানায় বিয়ে দিয়েছিলেন রানি ভিক্টোরিয়া। তাঁর সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে এসেছিলেন সাক্সে-কোবার্গ, ডেনমার্ক, বেলজিয়ামের রাজা ও অন্যান্য রাজপরিবারের সদস্যরা।
উৎসব শেষ হওয়ার পরদিন রানি ভিক্টোরিয়া প্রাতরাশ করতে ফ্রগমোর হাউসে যান। সঙ্গে ছিলেন কন্যা বিয়াট্রিস। সেখানে রানির জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁর বড় মেয়ে ব্রিটিশ প্রিন্সেস রয়্যাল ও জার্মানির সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া ও নাতনি ভিকি। সেদিন টেবিলে খাবার পরিবেশন করেছিলেন আবদুল করিম ও মোহাম্মদ বকশ।
রানি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, মোহাম্মদ বকশ দেখতে কৃষ্ণবর্ণের, মুখে সর্বদা হাসি লেগে আছে। সে তুলনায় আবদুল করিমের গায়ের রং হালকা, উচ্চতায় লম্বা, মুখ গুরুগম্ভীর। দুজনেই রানিকে খাবার পরিবেশন করছিলেন ধীর লয়ে, তাঁদের দৃষ্টি ছিল নিচে। তারপর দুজনে নত হয়ে রানির পায়ে চুমু খেলেন। তারপর যখন উঠতে যাবেন, তখনই যুবক আবদুল করিমের চোখাচোখি হয় রানির সঙ্গে।
দুই ভারতীয় ভৃত্যকেই ভালো লাগে রানি ভিক্টোরিয়ার। তিনি দুজনকে নিজের ব্যক্তিগত সেবার কাজে নিযুক্ত করেন। একই সঙ্গে তাঁদের নিজেদের ধর্মীয় রীতি মেনে আলাদা রান্নার অনুমতি দেন।
কিছুদিন পর রানি উইন্ডসর থেকে অসবর্ন হাউসে যান। সমুদ্রতীরবর্তী দ্বীপের এই ভবন ভিক্টোরিয়া নিজে কিনেছিলেন। এখানেই রানি তাঁর সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটাতে পছন্দ করতেন।
রানির নজরে আবদুল
কয়েক সপ্তাহ পর একদিন আবদুল করিম ভাবলেন, তিনি রানিকে চমক দেবেন। অসবর্ন হাউসের রান্নাঘরে নিজের মসলার বাক্সটি নিয়ে এসে আবদুল রান্না করলেন চিকেন কারি, ডাল, সুগন্ধি পোলাও। কিছুদিনের মধ্যেই আবার রান্না করলেন মোগল রেসিপি বিরিয়ানি, দম পোখত, কোরমা।
প্রথমবারের মতো রানি ভিক্টোরিয়া ভারতীয় রান্নার স্বাদ–গন্ধ উপভোগ করলেন। তাঁর কাছে এতই ভালো লেগে গেল যে নিজের বাবুর্চিদের নিয়মিত এসব পদ রান্না করতে বলে দিলেন।
রানির নতুন দুই ভৃত্য খুব জলদি ব্রিটিশ রাজপরিবারকে খাবার পরিবেশনের আদবকেতা শিখে নিলেন। এমনকি খাবারের শেষে রাজপরিবারের কোন সদস্য কোন মিষ্টি, চকলেট বা বিস্কুট পছন্দ করেন—সবই তাঁদের আয়ত্তে ছিল। রানি ভিক্টোরিয়া ক্রমে তাঁর ভারতীয় ভৃত্যদের ওপর নির্ভরশীল হতে থাকলেন। তাঁদের পোশাক কী হবে, তাঁদের কাজ কী হবে, তাঁরা কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে—এসব নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন।
আবদুল করিম ও মোহাম্মদ বকশ যাতে ইংরেজি ভালো বলতে পারেন, সে জন্য রানির নির্দেশে আলাদা শিক্ষক রাখা হলো। একই সঙ্গে ভিক্টোরিয়া আবদুল করিমের কাছে ‘হিন্দুস্তানি’ ভাষা শিখতে চাইলেন। হিন্দুস্তানি বলতে আদতে কোনো ভাষা ছিল না কখনো৷ ব্রিটিশরা কাছাকাছি উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গির হিন্দি ও উর্দু ভাষাকে একসঙ্গে বলত হিন্দুস্তানি—হিন্দুস্তান তথা ভারতের ভাষা।
আবদুল এই নতুন দায়িত্বটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। প্রতি সন্ধ্যায় তিনি রানির সঙ্গে বসতে থাকলেন। প্রথমে রানিকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কিছু উর্দু শব্দ শেখাতে শুরু করলেন আবদুল। এসব শব্দ লালরঙা একটি ছোট নোটবুকে ভিক্টোরিয়া টুকে রাখতেন। সব সময় এটি তিনি হাতের কাছে রাখতেন।
কিছুদিনের মধ্যেই রানি অগ্রগতি করলেন। আবদুল করিম এবার রানিকে উর্দু বাক্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি প্রথমে একটি উর্দু বাক্য লিখতেন, তারপর সেটির ইংরেজি অনুবাদ লিখতেন, শেষে রোমান হরফে বাক্যটির উর্দু উচ্চারণ লিখতেন। প্রতিদিন রানি এগুলো তাঁর নোটবুকে হুবহু টুকে নিতেন।
ভিক্টোরিয়া তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ভৃত্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তিনি হিন্দুস্তানি শিখছেন। ভারতীয় এই ভাষা ও ভারতীয় মানুষ দুটোতেই তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এর আগে কখনোই এত কাছ থেকে এই সম্পর্কে জানাবোঝার সুযোগ হয়নি তাঁর।
এমনকি রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর ব্যক্তিগত সচিব স্যার হেনরি পনসনবিকেও কিছু হিন্দুস্তানি শব্দ শিখতে বললেন। আবদুলের কাছে উর্দু শেখার মাধ্যমে রানি যেন এক অন্য জগতে প্রবেশ করলেন৷ ভিন্ন ভূমি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারলেন।
ভিক্টোরিয়া উর্দু ভাষা ধ্বনিতরঙ্গ শুনতে খুব পছন্দ করলেন। মোগল দরবারে ব্যবহৃত এই সমৃদ্ধ ভাষাটি ফারসি ও স্থানীয় ব্রজভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। আবদুল তাঁকে ভারত আর তাঁর শহর আগ্রা সম্পর্কে বলতেন। বলতেন আগ্রার তাজমহল সম্পর্কে, যা মোগল সম্রাট শাহজাহান তৈরি করিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশে। কীভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজের মৃত্যু শাহজাহানকে ভীষণ দুঃখ দিয়েছিল। মৃত্যুর পর শাহজাহানও সমাহিত হয়েছিলেন তাজমহলে।
তাজমহলের এই কাহিনির সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়া ভীষণভাবে একাত্মবোধ করলেন। তাজমহলের মতোই ভিক্টোরিয়া স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের জন্য ফ্রগমোর হাউসে একটি সমাধিসৌধ তৈরি করেছেন। মৃত্যুর পর রানির ঠাঁইও হবে সেখানে।
একদিন আবদুল করিমকে রানি তাঁর সঙ্গে হিন্দুস্তানিতে কথা বলতে বললেন। তবে আস্তে আস্তে, যাতে তিনি বুঝতে পারেন ও শিখতে পারেন। আবদুল করিম বুঝতে পারলেন, রানি উর্দু শেখার জন্য কতটা আগ্রহী।
এরপর রানি অসবর্ন থেকে বালমোরাল ক্যাসলে যাওয়ার কথা। স্কটল্যান্ডের ঠান্ডায় যাতে আবদুল ও মোহাম্মদের কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক জেমস রিডকে তিনি কিছু নির্দেশনা দিলেন। এর মধ্যে ছিল দুই ভারতীয়র জন্য গরম কাপড়, হাতের গ্লাভস নেওয়া, স্কটল্যান্ডের আবহাওয়ায় তাঁরা কখন কোন কাপড় পরবেন, সেখানে তাঁদের কাজ কী হবে ইত্যাদি। তাঁরা যেন সব সময় পাগড়ি পরে থাকেন, সে ব্যাপারেও ভিক্টোরিয়া নির্দেশনা দিলেন। দেশ থেকে এত দূরে এসে তাঁরা যাতে একাকিত্বে না ভোগেন, অন্যরা যাতে তাঁদের আলাদা করে না দেখেন, সে ব্যাপারেও নির্দেশনা ছিল।
স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসলে ভিক্টোরিয়ার কিছু সুখস্মৃতি আছে। তাঁর স্বামী অ্যালবার্ট ১৮৪৮ সালে এই ভবন কিনেছিলেন। এখানে আসার পর রানি আবদুল ও মোহাম্মদকে প্রতিদিন প্রাতরাশের সময় টেবিলে পরিবেশক হিসেবে উপস্থিত থাকতে বললেন। প্রাতরাশের পর তাঁদের ইংরেজি প্রশিক্ষণ চলবে। তারপর তাঁরা দুজনেই রানির মধ্যাহ্নভোজের সময় উপস্থিত হবেন। এরপর দুজন পালাক্রমে রানির সেবায় হাজির থাকবেন।
দুজনের মধ্যে আবদুল করিম ক্রমে রানির প্রিয় হয়ে উঠছিলেন। আবদুল যেন তাড়াতাড়ি ইংরেজি শিখতে পারেন, সে জন্য তাঁকে বেশি করে প্রশিক্ষণ নিতে বললেন। এ জন্য প্রায় সময় আবদুলের বদলে মোহাম্মদকে রানির খেদমতে থাকতে হতো।
আবদুলের উত্থান
আবদুলের ইংরেজি দ্রুত ভালো হতে থাকল। রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করতে শুরু করলেন তিনি। রানিকে আবদুল নিজের পরিবার সম্পর্কে বললেন। বললেন, তিনি খুব ভালো পরিবার থেকে এসেছেন। তাঁর বাবা আগ্রা জেলে কর্মরত একজন চিকিৎসক, তিনি নিজে সেখানে করণিকের কাজ করতেন। আগে কখনোই তিনি ছোটখাটো কাজ করেননি। এরপরই এক চিঠিতে ভিক্টোরিয়া লিখেছেন, তরুণ আবদুল একজন ভদ্রলোক। তাঁকে ভৃত্য হিসেবে মানায় না। তিনি অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত।
দ্রুতই আবদুলের ইংরেজি এত ভালো হয়ে গেল যে রানিকে তাঁর দাপ্তরিক কাজে সাহায্য করা শুরু করলেন। মোহাম্মদ বকশ যেখানে আগের মতোই রানিকে খাবার পরিবেশনের কাজে নিযুক্ত থাকলেন, সেখানে আবদুল করিম সাচিবিক কাজ করছিলেন।
ভিক্টোরিয়া আবদুল করিমকে ভারত সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে থাকলেন। প্রথম দিকে আলোচনার বিষয়বস্তু হালকা থাকলেও পরে রাজনীতির মতো গুরুতর বিষয়েও ভিক্টোরিয়া আবদুলকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। ভিক্টোরিয়া ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও প্রথা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আবদুল তাঁকে হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মীয় প্রথার মধ্যে পার্থক্যের কথা জানালেন। এ কারণে মুসলিমদের মহররম ও হিন্দুদের মকরসংক্রান্তি কাছাকাছি সময়ে হলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়, সে কথা বললেন। আবদুল রানিকে বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কারণেই মূলত এসব উত্তেজনা তৈরি হয়। রানি এসব শুনে অস্থির হলেন, ভাইসরয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনার কথা ভাবলেন।
এদিকে আবদুলের প্রতি ভিক্টোরিয়ার এমন আনুকূল্য রাজপরিবার ও প্রাসাদের অন্য সদস্যরা বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করলেন। তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছিল ভিক্টোরিয়ার প্রয়াত এক সহচর জন ব্রাউনের কথা। প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর ভিক্টোরিয়া একদম হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। ৪২ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বাকি জীবন কালো ছাড়া আর কোনো রঙের পোশাক পরবেন না। তাঁর কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার ভার পড়েছিল অ্যালবার্টেরই সহচর জন ব্রাউনের ওপর। জন ব্রাউন তাতে সক্ষম হন৷ তাঁর ওপর রানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ব্রাউনের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার সম্পর্ক নিয়ে রাজমহলে নানা কানাঘুষা শুরু হয়৷ অনেকে ভিক্টোরিয়াকে ‘মিসেস ব্রাউন’ বলা শুরু করেন।
১৮৮৩ সালে জন ব্রাউন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর রানি ভিক্টোরিয়া এবার আরেকজন সহচরের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সবার কাছে মনে হচ্ছিল, জন ব্রাউনের শূন্যতা পূরণ করছেন আবদুল করিম। দুই মাসের মধ্যে আবদুল করিম ভিক্টোরিয়ার হাতের লেখা বোঝার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠলেন, যা কিনা রানির ব্যক্তিগত সচিব স্যার পনসনবিও বেশির ভাগ সময় ধরতে পারতেন না।
আবদুল করিমের প্রভাবে রানি ভারত সম্পর্কে আরও আগ্রহী হয়ে উঠছিলেন। ভাইসরয়কে নিয়মিত চিঠি লেখা শুরু করলেন, ভারত সম্পর্কে সরকারের মন্ত্রী ও ভারতীয় রাজপরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আরও জানতে চাইতেন।
ভৃত্য থেকে মুনশি
১৮৮৮ সালের ১৫ জুন জার্মানির সম্রাট তৃতীয় ফ্রেডেরিক ক্যানসারে মারা যান। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার বড় মেয়ে ভিক্টোরিয়ার স্বামী। খবর শুনে রানি মুষড়ে পড়েন। নতুন সম্রাট দ্বিতীয় উইলহেম তাঁর মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতেন না। প্রিয় মেয়ে ভিক্টোরিয়ার চিন্তায় মা ভিক্টোরিয়া আরও চিন্তিত হয়ে পড়েন।
শোক ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রানি ভিক্টোরিয়ার ওই দিনগুলোতে তাঁর পাশে ছিলেন আবদুল করিম। তিনি রানির উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার কথা মন দিয়ে শুনলেন। রানিও আবদুলের সঙ্গে কথা বলে কিছুটা নির্ভার বোধ করলেন। আবদুল নতুন জার্মান সম্রাটের সমালোচনাও করেন।
রানির ওপর আবদুলের প্রভাব ক্রমে বাড়তে থাকলেও আবদুল নিজের অবস্থান নিয়ে খুশি ছিলেন না। তাঁর চিঠিপত্রে দেখা যায়, এ সময় তিনি ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। আগ্রা জেলের কারাধ্যক্ষ জন টাইলার আবদুলকে রানির বিশেষ সহচর হওয়ার কথা বলে তাঁকে ব্রিটেন নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু এখানে এসে তিনি সামান্য ভৃত্য হয়ে রয়েছেন। নিজের সামাজিক অবস্থান নিয়ে তিনি মোটেই খুশি ছিলেন না।
আবদুল এ ব্যাপারে সরাসরি রানির সঙ্গে কথা বলেন। তিনি রানিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে অন্য ভারতীয় ভৃত্যদের চেয়ে তিনি সামাজিক মর্যাদায় এগিয়ে। এ কথা শোনার পর রানি বিন্দুমাত্র দেরি না করে সিদ্ধান্ত নেন, আবদুলের পদমর্যাদা তিনি বাড়িয়ে দেবেন। কোনো অবস্থাতেই আবদুলকে যেতে দেবেন না।
১৮৮৮ সালের ১১ আগস্ট রানি তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, তিনি আবদুল করিমকে ‘মুনশি’ বা শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করছেন। তিনি এটাও লেখেন, আবদুলকে ভৃত্য হিসেবে ভারত থেকে আনাই উচিত হয়নি। ভারতে আরও বেশি সামাজিক মর্যাদায় আবদুল কাজ করতেন।
আবদুল এখন মুনশি হাফিজ আবদুল করিম। তাঁর বেতন বাড়িয়ে করা হয় মাসে ১২ পাউন্ড। এক বছরের মধ্যেই আবদুল রানির দরবারে গুরুত্বপূর্ণ পদের পাশাপাশি তাঁর বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হন। এরই মধ্যে ভারত থেকে আরও কয়েকজন ভারতীয় ভৃত্যকে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের ভার পড়ে মুনশি আবদুল করিমের ওপর। এ ছাড়া রানি চিত্রকর জোয়াকিম ভন অ্যাঞ্জেলিকে আবদুলের প্রতিকৃতি আঁকার নির্দেশ দেন।
ধীরে ধীরে ব্রিটিশ রাজমহলের বাকি সব সদস্য খেয়াল করতে শুরু করলেন, জন ব্রাউনের মতোই আবদুল করিমের কোনো সমালোচনা রানি শুনছেন না। এমনকি রানি আবদুলকে প্রাসাদের সেই কক্ষে থাকতে দিলেন, যেখানে একসময় জন ব্রাউন থাকতেন।
কিছুদিন পর আবদুল করিম বার্ষিক ছুটিতে ভারতে ফিরলেন। রানির সঙ্গে তাঁর নিয়মিত চিঠি চালাচালি চলত। আবদুল রানিকে লেখেন, তাঁর পিতা ওয়াজিরউদ্দিন অল্প কিছু সময় পর অবসরে যাবেন। সে সময় তাঁদের পরিবার অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে পড়তে পারে। এ জন্য ওয়াজিরউদ্দিনকে মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়। পত্রপাঠমাত্রই রানি ভাইসরয় লর্ড ল্যানসডোনকে চিঠি লেখেন এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে।
বাড়তে থাকা প্রভাব
চার মাস পর আবদুল ব্রিটেনে ফিরে আসেন। এবার ব্রিটিশ রাজমহলের সদস্য ছাড়াও ভারতীয় ভৃত্যদের কেউ কেউ আবদুলের বাড়তে থাকা প্রতিপত্তি ও উদ্ধত আচরণ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে একজন আহমেদ হুসেইন রানির চিকিৎসক জেমিস রিডের কাছে অভিযোগ করেন, আবদুল তাঁদের সঙ্গে অত্যন্ত কঠোর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করেন।
এ কথা জানানোর পর ভিক্টোরিয়া মুনশির পক্ষাবলম্বন করেন। জেমস রিডকে বলেন, আহমেদ হুসেন আবদুলের নামে এসব ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ জানালে রিড যেন সেসবে কান না দেন। আহমেদ আবদুলকে ঈর্ষা করেন। আবদুলের নামে আহমেদ বারবার অভিযোগ দিতে থাকলে একসময় তাঁকে ভারতে ফিরে যেতে বলা হয়।
এদিকে আরেক ভৃত্য—সম্পর্কে আবদুল করিমের শ্যালক—হুরমত আলীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ওঠে। রানির দামি একটি ব্রোচ পিন হারানো যায়। মোহাম্মদ বকশ জানায়, হুরমত সেটি বাগানে কুড়িয়ে পেয়েছিল। এরপর ওয়াগল্যান্ড নামক গয়নার দোকানে সেটি বিক্রি করে দেয়৷ সেখানে যোগাযোগ করা হলে তারা ব্রোচটি ফেরত দিয়ে চিঠিতে জানায়, একজন ভারতীয় এসে এটি তাঁদের কাছে বিক্রি করেছিল।
এ ব্যাপারে রানিকে সব জানানো হলে রানি আবদুলের সঙ্গেই আলোচনা করেন। আবদুল রানিকে বোঝান, হুরমতের মতো সৎ লোক হয় না৷ তিনি এটা পেয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু ভারতীয় রীতি হচ্ছে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস নিজের কাছে রেখে দেওয়া এবং এ ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলা!
জেমস রিড তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, স্পষ্টত এটি ছিল চুরির ঘটনা। রানির কারণে তাঁরা হুরমতের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আরও কিছুদিন পর রিড আবদুলের প্রতি আরও ক্ষুব্ধ হন। রানি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকের শয়নকক্ষ পরিবর্তন করে সেটি আবদুলকে দিয়ে দেন!
রানি একবার আবদুলকে নিয়ে একা চলে যান বালমোরাল থেকে একটু দুর্গম গ্লাসলট শিয়েল ভবনে, সবার কাছে যেটি পরিচিত ছিল ‘উইডোজ কটেজ’ হিসেবে। প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর রানি ভিক্টোরিয়া প্রথম এই বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৬৮ সালে জন ব্রাউনের সঙ্গে বাড়িটির উদ্বোধন করেন তিনি। অ্যালবার্ট ও ব্রাউনের স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়িটিতে তিনি একা চলে গেছেন আবদুলকে নিয়ে। রাজমহলের সব ব্রিটিশ কর্মচারী বিস্মিত হয়েছিলেন।
১৮৯০ সালে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আবদুল খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। রানির নির্দেশে চিকিৎসক জেমস রিড আবদুলকে পরীক্ষা করেন। আবদুলের ঘাড়ে একটি ফোড়া হয়। অসবর্ন হাউসের চিকিৎসালয়ে তাঁর ঘাড়ের অপারেশন হয়।
এ সময় ভিক্টোরিয়া প্রতিদিন দুবার এসে আবদুলকে দেখে যেতেন। একটু ভালো বোধ করলে এ ঘরেই আবদুল রানিকে উর্দু শেখাতেন।
রানি তাঁর অধীন যে কারও অসুস্থতায় চিন্তিত হতেন, কিন্তু আবদুলের ব্যাপারে যে ব্যক্তিগত যত্ন তিনি নিয়েছিলেন, সেটি নজিরবিহীন। রাজমহলে বলাবলি শুরু হয়, একজন সম্রাজ্ঞীর পক্ষে এমন আচরণ শোভন নয়। কিন্তু রানি ভিক্টোরিয়া এসব সমালোচনাকে পাত্তা দিতেন না।
আগ্রায় আবদুলের জমি
রাজদরবারে আবদুলের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা অসন্তোষ আর ক্ষোভ আঁচ করে রানি ভিক্টোরিয়া আবদুল করিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। রানির মৃত্যুর পর আবদুলের কী হবে, সেটা নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন।
রানি ভিক্টোরিয়া ভারতে ভাইসরয় ল্যানসডোন ও সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড ক্রসকে চিঠি লিখতে শুরু করেন। রানি লেখেন, এমন একটি বড় সরকারি জমি খুঁজে বের করতে, যা তিনি তাঁর মুনশি আবদুল করিমকে অনুদান দেবেন।
এর আগে কখনোই ভারতীয় কোনো বেসামরিক ব্যক্তিকে এমনভাবে জমি অনুদানের নজির নেই। স্থানীয় প্রশাসনের সেই ক্ষমতা নেই। ভাইসরয় রানিকে লেখেন, তারপরও রানি যদি ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে জমি অনুদানের ব্যাপারে তিনি পদক্ষেপ নেবেন।
রানি এরপর আরও কয়েক দফা চিঠি চালাচালি করেন। এ দফায় ভাইসরয় নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু উপযুক্ত জমি খুঁজে পাওয়া সহজ হয় না। রানির শর্ত ছিল, জমি হতে হবে আগ্রার কেন্দ্রস্থলে। ভাইসরয় রানিকে লেখেন, মুনশি আবদুলকে এমন একটি জমি দেওয়া ঠিক হবে, যার জন্য সরকারকে বার্ষিক ৩০০ রুপি কর দিতে হবে। একজন সেনা কর্মকর্তা দীর্ঘকাল সরকারের জন্য কাজ করার পর তাঁকে এই পরিমাণ করের জমি দেওয়া হতো।
কিন্তু রানি ভাইসরয়কে লেখেন, ৩০০ রুপি করের জমি মুনশির জন্য যথেষ্ট হবে না। তাঁর জন্য দ্বিগুণ পরিমাণ, অর্থাৎ বার্ষিক ৬০০ রুপি বা তার বেশি করের জমি বরাদ্দ দিতে হবে। আগ্রা শহরের কেন্দ্রস্থলে এত বড় জমি সহজলভ্য ছিল না।
ভাইসরয় ও সেক্রেটারি অব স্টেটকে রানি বারবার চিঠি লিখতে থাকেন। তাঁর প্রিয় মুনশিকে তিনি জমি বরাদ্দ করবেনই, তাতে প্রশাসনিক কোনো দেরি তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না, অদ্ভুত এক তাড়া ও জেদের প্রকাশ রানির চিঠিগুলোতে পাওয়া যায়।
প্রিয় মুনশির জন্য আগ্রায় কেবল জমি বরাদ্দ নয়, তাঁর সামাজিক অবস্থান পরিবর্তনের ব্যাপারেও রানি উদ্যোগী হন। তিনি সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড ক্রসকে লেখেন, আবদুল করিমকে রানি যে মুনশি পদে নিযুক্ত করেছেন, তা কোনো সরকারি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা যায় কি না। উত্তর আসে, আবদুলের নিযুক্তি কোনো সরকারি নিয়োগ নয়, রানির ব্যক্তিগত নিয়োগ। তবু রানি এ ব্যাপারে চাপ দিতে থাকেন। এরপর ভাইসরয় রানিকে লেখেন, বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের সুযোগ না থাকলেও যাতে সবাই আবদুলের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন, সে ব্যাপারে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
এদিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি জমি পাওয়া যায়। জমিটি ছিল আগ্রার শহরতলিতে। মুনশি আবদুলও এর মধ্যে চার মাসের বার্ষিক ছুটি নিয়ে ভারতে আসেন। ভাইসরয়ের জন্য আবদুল হাতে করে রানির একটি চিঠি নিয়ে আসেন। সেই চিঠিতে লেখা ছিল, আবদুলের বাবার জন্য এর আগে যে পেনশন দেওয়ার কথা হয়েছিল, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে। এ ছাড়া আগ্রা জেলে কর্মরত ওয়াজিরউদ্দিনের অবসরের পর তাঁর ওই পদে জামাতা ইলম উল্লাহকে চাকরি দেওয়ার কথাও বলেন রানি। আবদুল রানিকে বলেছিলেন, ইলমও ২৫ বছর ধরে ডাক্তারি পেশায় আছেন।
এ ছাড়া রানি ভাইসরয়কে লেখেন, আবদুল ফিরে যাওয়ার আগেই যেন জমিবিষয়ক দাপ্তরিক সব কাজ শেষ হয়। এ ছাড়া মুনশি ভারতে থাকার সময় তাঁকে যেন দরবার হলের অনুষ্ঠানগুলোতে ডাকা হয়, রানি সে নির্দেশনাও দেন।
দফায় দফায় চিঠি লিখে রানি ভিক্টোরিয়া আবদুল করিমকে আগ্রায় একখণ্ড জমি দিতে সমর্থ হন। আবদুল ফেরার আগেই তাঁর কাছে জমির দলিল হস্তান্তর করা হয়। ভারত প্রশাসনের সঙ্গে বিভিন্ন সময় মুনশি আবদুল করিম ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে যখনই রানি যোগাযোগ করেছেন কিংবা নির্দেশনা দিয়েছেন, তিনি হয় বাধা পেয়েছেন কিংবা নির্দেশ পালনে একধরনের শৈথিল্য দেখেছেন।
ওই দিকে মুনশি আবদুলের প্রভাবে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতের রাজনীতি ও ব্রিটিশ সরকারের ভারত শাসনপদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। মণিপুরে ব্রিটিশ সরকার যখন সেনাপতিকে উচ্ছেদ করে নিজেদের লোক নিযুক্ত করে, তখন রানি নির্দেশ দেন মণিপুরের যুবরাজকে যেন হত্যা না করা হয়। ১৮৯৩ সালে বোম্বেতে যে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছিল, সে ব্যাপারেও রানি তাঁর চিন্তা জাহির করেছিলেন। এসব দাঙ্গা দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়, এমনটা ভাবতেন রানি।
রানিকে আবদুল করিম বুঝিয়েছিলেন, ভারতে তাঁর ও রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু তারা ব্রিটিশ সরকারকে অপছন্দ করে এবং বিশ্বাস করে না। স্থানীয় প্রশাসনও সাধারণ মানুষের প্রতি সদয় নয়।
রানি মনে করতেন, ভারতের মতো বড় দেশ শাসন করা উচিত দৃঢ়ভাবে, তবে একই সঙ্গে নানা পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার পথ খোলা রেখে। ভয় দেখিয়ে, দমন-নিপীড়ন করে ভারত শাসন বেশি দিন সম্ভব নয়। রানির এই উপলব্ধি যে ঠিক ছিল, তা ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তেমন কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও রানি ভিক্টোরিয়া যা বুঝেছিলেন, তাঁর পরবর্তী রাজারা ও তাঁদের ব্রিটিশ প্রশাসন তা বুঝতে অসমর্থ ছিল।
হীরকজয়ন্তীতে বিরোধ
১৮৯২ সালের জুনে মুনশির বাবা হাজি ওয়াজিরউদ্দিন ব্রিটেনে যান। রানি তাঁকে সেই কক্ষ দেন, যা সাধারণত প্রধানমন্ত্রী লর্ড সলসবারির জন্য বরাদ্দ ছিল। পরের বছর ওয়াজিরউদ্দিন অবসরে যান। এরপর রানির নির্দেশে তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৮৯৫ সালে মুনশিকে দেওয়া হয় ‘কম্প্যানিয়ন অব দ্য অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ (সিআইই) উপাধি।
মুনশিকে রানি তাঁর তিনটি প্রাসাদেই আলাদা বাড়ি দেন। উইন্ডসর ক্যাসলে ফ্রগমোর কটেজ, অসবর্ন হাউসে আর্থার কটেজ ও বালমোরাল ক্যাসলে করিম কটেজ। মুনশি করিমকে রানি এতটাই পছন্দ করতেন যে তাঁর নামেই বালমোরাল ক্যাসলে বাড়ি নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই বাড়ির প্রতিটি আসবাব আবদুলের তত্ত্বাবধানে কেনা হয়। রাজপরিবার তার সমস্ত খরচ বহন করে।
আবদুল করিম তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়িকে ব্রিটেনে নিয়ে আসেন। এরপর প্রায়ই রানি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। প্রাসাদে আবদুলের স্ত্রী ও শাশুড়ি ‘পর্দা লেডিজ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অনেক সময় দিনে একাধিকবার আবদুল করিমের বাসভবনে রানি আসতেন। প্রায়ই আবদুল করিমকে ছোট নোট পাঠিয়ে রানি তাঁর আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আসতেন। মুনশিকে তাঁদের আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে হতো।
রানির ওপর মুনশির প্রভাবের কথা রাজপ্রাসাদের অন্দর থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। পত্রপত্রিকায় আবদুলকে নিয়ে আর্টিকেল প্রকাশিত হতে লাগল। এসব লেখায় মুনশি আবদুল করিম যে রানি ভিক্টোরিয়ার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র, তা প্রকাশিত হলো।
ভিক্টোরিয়া তাঁর প্রিয় মুনশিকে ভারতীয় সচিব পদে নিযুক্ত করলেন। এবার সবাই যেন প্রমাদ গুনলেন। রাজপরিবারের সদস্য থেকে ব্রিটিশ সরকার—সবাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, রানি ভারতবিষয়ক সব গোপন নথি মুনশিকে দেখাচ্ছেন। মুনশি যদি নিজে কিংবা তাঁর কোনো বন্ধুর মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তাহলে সেটি ব্রিটিশ সরকারের জন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তার ব্যাপার হবে। এ জন্য রানি ভিক্টোরিয়ার অজান্তে সরকার মুনশি আবদুল করিমের প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজরদারি শুরু করে দেয়।
এসবের মধ্যে ভিক্টোরিয়ার ব্রিটিশ সিংহাসন আরোহণের ৬০ বছর পূর্তি অর্থাৎ হীরকজয়ন্তীর সময় চলে আসে। একই সঙ্গে আবদুল করিমের ব্রিটেনে পদার্পণের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
রাজপ্রাসাদের অন্য সদস্যদের কাছে ১৮৯৭ সালটি ছিল ‘মুনশির বছর’। কারণ, ভিক্টোরিয়া হীরকজয়ন্তীবিষয়ক সব দাপ্তরিক কাজ আবদুল করিমের সঙ্গে আলোচনা করে করছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা, অতিথির তালিকায় কারা কারা থাকবেন, তা ঠিক করা, রানির বিভিন্ন চিঠি সাজিয়ে রাখা ইত্যাদি।
মুনশি এ সময় প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। রানির চিকিৎসক জেমস রিড রাজপ্রাসাদের অন্য সদস্যদের জানান, মুনশি গুরুতর অসুস্থ। তাঁর যৌনরোগের চিকিৎসা চলছে। তবু রানি ভিক্টোরিয়া মুনশিকে তাঁর সঙ্গে ভ্রমণে ফ্রান্সের সিমিয়ে শহরে নিতে চান। এর অর্থ সেখানে সবাইকে আবদুলের সঙ্গে এক টেবিলে খেতে হবে।
এ কথা শুনে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, যদি মুনশি সিমিয়েতে যায়, তাহলে সবাই গণপদত্যাগ করবেন। রানির ব্যক্তিগত পরিচারিকা হ্যারিয়েট পিফসের ওপর দায়িত্ব পড়ল এ কথা রানিকে জানানোর। দুরু দুরু বুকে পিফস যখন ৭৮ বছর বয়সী রানিকে তাঁদের সিদ্ধান্তের কথা বলেন, ভিক্টোরিয়া রেগে আগুন হয়ে যান। তাঁর টেবিলে থাকা বই, কলম, কাগজ, মেমো, বক্সসহ সবকিছু তিনি ছুড়ে ফেলে দেন। ঘরে থাকা কাচের বিভিন্ন জিনিস তিনি ভেঙে ফেলেন। রানির এই ক্রুদ্ধ মূর্তি দেখে সবাই চুপ মেরে যান, কেউ আর পদত্যাগ করেননি।
এ ঘটনার পর রানির সন্তানেরা, বিশেষ করে প্রিন্স অব ওয়েলস অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড (পরবর্তী রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড), প্রিন্সেস বিয়াট্রিস প্রকাশ্যে মুনশির বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। রানির কাছ থেকে মুনশিকে দূরে সরাতে সবাই মিলে কয়েকবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবার রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর ভারতীয় মুনশির পক্ষে দেয়াল হয়ে দাঁড়ান। তাঁর কাছে সবার এই বিরুদ্ধাচরণ ছিল বর্ণবাদ ও উচ্চশ্রেণি সমাজের উন্নাসিকতাপ্রসূত। রানি এ ধরনের আচরণকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেন।
রানি মুনশিকে নাইটহুড বা ‘নাইট কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার’ (কেসিআইই) উপাধিও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজপরিবার ও সরকারের সম্মিলিত প্রতিবাদে তার কম মর্যাদার উপাধি কম্প্যানিয়ন অব দ্য রয়্যাল ভিক্টোরিয়ান অর্ডার (সিভিও) উপাধিতে মুনশি আবদুল করিমকে ভূষিত করা হয়, ১৮৯৯ সালে।
রানির জীবদ্দশায় মুনশির বিরুদ্ধে কিছু করা যে সম্ভব নয়, সেটি সবাই বুঝে যায়।
রানির মৃত্যু, মুনশির মৃত্যু
১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি ব্রিটেনের রানি ও ভারতসম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া অসবর্ন হাউসে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রানির ইচ্ছামতো তাঁর কফিনকে সাজান চিকিৎসক জেমস রিড।
এরপর রিড প্রয়াত রানির পরিবার ও রাজপ্রাসাদের সদস্যদের এক এক করে ডাকেন। রানি ভিক্টোরিয়ার প্রতি অন্তিমবার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন সবাই। শেষমেশ মুনশি আবদুল করিমকে ডাকা হয়। তাঁকে কিছু সময়ের জন্য রানির কাছে একা থাকতে দেওয়া হয়। আবদুলই সবশেষে রানিকে একা দেখেন। আবদুল বেরিয়ে এলে রাজপরিবারের সদস্যরা রানির কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁদের উপস্থিতিতে ভিক্টোরিয়ার কফিন বন্ধ করা হয়।
পরদিন উইন্ডসর ক্যাসলের কাছাকাছি ফ্রগমোরে প্রিন্স অ্যালবার্টের সমাধিতে রানি ভিক্টোরিয়াকে সমাহিত করা হয়। রানিকে তাঁর নিজের ‘তাজমহলে’ সমাহিত হতে দেখেন মুনশি আবদুল করিম। রানি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর শবযাত্রায় তাঁর পরিবার, রাজপ্রাসাদের সদস্য ও ইউরোপীয় অন্য রাজঘরানার সদস্যদের সঙ্গে হাঁটবেন তাঁর মুনশি। রানি তাঁর মৃত্যুতেও ভোলেননি তাঁর প্রিয় মুনশিকে।
মুনশির জন্য এখানেই সব শেষ। নতুন রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড প্রিন্সেস বিয়াট্রিস, নতুন রানি আলেকজান্দ্রা ও কয়েকজন রক্ষীকে পাঠান আবদুলের বাসভবন ফ্রগমোর কটেজে। পুরো ভবন তছনছ করে বের করা হয় আবদুলকে দেওয়া রানি ভিক্টোরিয়ার চিঠিপত্র। সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা হয়। মুনশি, তাঁর স্ত্রী ও ভাতিজাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে।
মুনশি চলে যেতেই তাঁর তিনটি বাসভবন অন্যদের দিয়ে দেওয়া হয়। অসবর্নের আর্থার কটেজ দেওয়া হয় চিকিৎসক জেমস রিডকে৷ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ইতিহাসে রানি ভিক্টোরিয়ার জীবনী থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন আবদুল করিমের নাম-নিশানা। এমনকি প্রাসাদের সব ভারতীয় ভৃত্যকে ফেরত পাঠানো হয়। প্রিন্সেস বিয়াট্রিস রানি ভিক্টোরিয়ার ডায়েরি ও নোটের অনেক কিছু ধ্বংস করেন।
রানি ভিক্টোরিয়ার পরিবার যা কখনো বুঝতে পারেনি, সেটা হলো তিনি ছিলেন আজন্ম ভালোবাসার কাঙাল। রাজপ্রাসাদের বন্দী একাকী নিয়মবদ্ধ জীবন তাঁর কখনো ভালো লাগেনি। তাঁর শৈশব কেটেছে একাকী, অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন, মা–ও তাঁকে কঠোর হাতে মানুষ করেছেন। স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তিনি আবার একা হয়ে পড়েন।
সন্তানদের সঙ্গেও রানির সম্পর্ক অন্তরঙ্গ ছিল না। ভিক্টোরিয়ার মেয়ে প্রিন্সেস বিয়াট্রিস ও প্রিন্সেস হেলেনা সব সময় মায়ের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। এমনকি ভিক্টোরিয়া যখন মৃত্যুশয্যায়, তখনো রানির দেখভালের জন্য তাঁরা কখনো তাঁর কাছে যাননি। ভিক্টোরিয়ার পুত্র ও নাতিরাও তাঁকে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর কোথাও থেকে ভিক্টোরিয়া শান্তি পাননি।
এরপর রানির জীবনে এসেছিলেন সহচর জন ব্রাউন। ভিক্টোরিয়াকে তিনি রানি হিসেবে নন, দেখেছিলেন একজন সাধারণ নারী হিসেবে। সেভাবেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন ব্রাউন। তিনি রানির প্রতি সমর্পিত ছিলেন। একবার আততায়ীর হাত থেকে রানিকে বাঁচিয়েওছিলেন।
জন ব্রাউনের মৃত্যুর পর রানি আবার একা হয়ে পড়েন। তারপর তাঁর জীবনে আসেন আবদুল করিম। খুব দ্রুতই তিনি ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি চলে আসেন। রানি অনুভব করলেন, তিনি আবদুলের সঙ্গে ভাষার সমস্যা সত্ত্বেও স্বচ্ছন্দে যেকোনো বিষয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারেন, যা কিনা রাজপরিবারের আর কারও সঙ্গে তিনি পারেন না। আবদুল অত্যন্ত সম্মান দেখিয়ে রানির সঙ্গে ব্যবহার করতেন। অধিকাংশ চিঠিতে ভিক্টোরিয়া আবদুলকে তাঁর পরম বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করেছেন। কখনো ভিক্টোরিয়া নিজেকে আবদুলের ‘স্নেহময়ী মা’ হিসেবে লিখেছেন।
আবদুল করিম আগ্রায় ফিরে ভিক্টোরিয়ার দেওয়া জমিতে ‘করিম লজ’ বাড়িতে থাকতেন। তাঁর বাড়িতে স্থানীয় লোকজন আসতেন। আবদুল তাঁদের রানির গল্প শোনাতেন।
একবার নতুন প্রিন্স অব ওয়েলস, পরবর্তী রাজা পঞ্চম জর্জ (রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দাদা) ভারত ভ্রমণে এলে তিনি মুনশি আবদুল করিমের বাসভবনে যান। আবদুল করিম তাঁকে আপ্যায়ন করেন। এ সময় আবদুল ‘সিভিও’ স্মারকটি পরে ছিলেন। সেবার প্রিন্স জর্জ তাজমহলের নিকটবর্তী ম্যাকডোনাল্ড পার্কে রানি ভিক্টোরিয়ার একটি ভাস্কর্য উন্মোচন করেন। আবদুল করিম অনেক সময় ভিক্টোরিয়ার সেই ভাস্কর্যের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন।
রানির মৃত্যুর মাত্র আট বছর পর, ১৯০৯ সালে তাঁর প্রিয় মুনশি আবদুল করিমও মৃত্যুবরণ করেন। এ খবর রাজা এডওয়ার্ডের কাছে পৌঁছানোর পর তিনি ভাইসরয় লর্ড মিন্টোকে চিঠি লিখে নির্দেশ দেন ‘করিম লজ’ তল্লাশি করে দেখতে।
রাজার আদেশে আবদুল করিমের স্ত্রী, ভাই আবদুল আজিজ ও ভাতিজা আবদুল রশিদের উপস্থিতিতে দুই দফা তল্লাশি চালানো হয়। উদ্ধার করা হয় আবদুলকে লেখা ভিক্টোরিয়ার নিজের হাতে লেখা আটটি চিঠি। মুনশির স্ত্রী বারবার ব্রিটিশ অফিসারদের বলেন, এগুলোই রানি ভিক্টোরিয়া আর তাঁর স্বামীর শেষ স্মৃতি। চিঠিগুলো পাঠানো হয় রাজার কাছে। আবদুলের পরিবারের বারবার আবেদন এবং ভারতের তৎকালীন উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে স্থানীয় প্রশাসনের সুপারিশে চারটি চিঠি ফেরত দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর আবদুল করিমের পরিবার পাকিস্তান চলে যায়। সেই সঙ্গে রাজপরিবার থেকে পাওয়া সব উপহারও হারিয়ে যায়। থেকে যায় কেবল মুনশি আবদুল করিমের ডায়েরি। আর ভিক্টোরিয়ার আঁকানো আবদুলের কিছু প্রতিকৃতি। রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে আবদুল করিমের বন্ধুত্বের কথা পৃথিবী জানবে আরও ১০০ বছর পর।
শ্রাবণী বসুর ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আবদুল: দ্য ট্রু স্টোরি অব দ্য কুইনস ক্লোজেস্ট কনফিডেন্ট অবলম্বনে