একুশের চেতনা হলো কথা বলার অধিকার 

সুমন সাজ্জাদ

অনেক ফাগুন এল, আবার চলেও গেল। রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়াগুলো এখনো ফোটে। রাজপথের রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। তবু সেই রক্তের দাগে খুঁজতে খুঁজতে আমরা ফিরে যাই আরও এক ফাল্গুনে—ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে। ২১ একটি সংখ্যামাত্র নয়, একুশ একটি চিহ্ন, আত্মপরিচয়ের রক্তাক্ত নকশা। আমরা বলি ‘একুশের চেতনা’, বলি ভাষার চেতনা। সব মিলিয়ে বলি ভাষার মাস। অন্য দিনগুলো কি ভাষার নয়? অবশ্যই ভাষার। কারণ, ভাষাই সংস্কৃতি, ভাষাই পরিচয়। ভাষা দিয়ে তৈরি হয় সম্পর্ক আর সংযোগের সেতু। ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ধারণ করে একুশের চেতনা বাঙালির মনের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রবাসনা।

রাষ্ট্র জন্মালেই কি ফুরিয়ে যায় রাষ্ট্র উদ্ভবের মৌলিক চেতনাগুলো? এ কথা ভাবি। ভাবি, একুশের চেতনা প্রকৃতপক্ষে কী? ইতিহাসের দিগন্তে তাকালে মনে হয়, একুশের চেতনা হলো ভাষার অধিকার, কথা বলার অধিকার; ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। এসবের উপস্থিতির অর্থ হলো, একুশের চেতনা সক্রিয়; আর অনুপস্থিতির মানে হলো, একুশের চেতনা অস্তিত্বহীন।

ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে; কিন্তু অন্য ভাষাগুলোর কথাও আমাদের ভাবতে হবে। বহু সংস্কৃতির এই বিশ্বে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ভাষার অস্তিত্বই কেবল স্বীকার করব, তা হতে পারে না। আমাদের বাংলাদেশেই আছে অনেকগুলো ভাষা; এই ভাষিক বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। বাঙালিকে জানতে হবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং ও সাঁওতালরা কী লিখছে। কেননা, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রসীমার ভেতরে ভাষাগুলো সচলভাবে টিকে আছে। খুব আশান্বিত হই, যখন একজন চাকমাভাষী কবি ও নাট্যকার বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। একুশের চেতনা এই স্বীকৃতির কথা বলে; অঞ্চল, দেশ ও রাষ্ট্রের সবাইকে করতে চায় অংশীজন।

ভাষা আন্দোলনের আলোকিত অধ্যায় আমাদের দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যাঁরা ভাষা নিয়ে কাজ করি কিংবা পড়াই, তাঁদের মনে রাখতে হয় ভাষার মান্য ও শুদ্ধ রূপের কথা। আঞ্চলিক ও সামাজিক ভাষার বৈচিত্র্য মনে রেখেই আমরা প্রমিত বাংলার কথা বলি। কারণ, প্রমিতায়ন না ঘটলে ভাষাগোষ্ঠীর ভাষিক স্বেচ্ছাচারিতা ভাষার মৃত্যু ডেকে আনে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়াতে গিয়ে দেখেছি, প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়ে আসার পরও বাঙালি শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ যথার্থভাবে বাংলা বলতে, লিখতে ও পড়তে পারে না। দক্ষতার এই ঘাটতি সম্প্রসারিত হয়ে যায় শিক্ষার উচ্চস্তর থেকে কর্মজীবন পর্যন্ত। এ কারণে নিজের ভাষার দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক প্রয়োগ দুর্বল হয়ে পড়ে। ইংরেজি মাধ্যম থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর অনেকে বাংলায় মর্মান্তিকভাবে দুর্বল। ইংরেজি উচ্চারণে তাঁদের বাংলা বলতে শুনি। সুন্দর বাংলা শব্দ থাকা সত্ত্বেও অনেকে কথার ভেতরে অপ্রয়োজনে মিশিয়ে দেন ইংরেজি ভাষার শব্দ। এই বিমিশ্রণ প্রকৃতপক্ষে জরুরি নয়।

বাংলাদেশের অনেকেই বাংলা ভাষাকে অর্থকরী ভাষামাধ্যম মনে করেন না। তাই বলে কি আমরা আশাবাদী হব না? নিশ্চয়ই হব। আমাদের ভাষাগুলোকে নিয়ে যেতে হবে প্রযুক্তিমাধ্যমের আওতায়। ভাষা শিখন ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। বিদেশিদের বাংলা শেখানোরও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের সব কটি ভাষার, সব কটি সংস্কৃতির অস্তিত্ব যেদিন দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে পারব, সেদিনই একুশের চেতনা সত্যিকারভাবে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

সুমন সাজ্জাদ: কবি ও প্রাবন্ধিক; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।