উড়োজাহাজে চড়ানোর পর মাকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন সেই শিপন

মা গীরু বালা রায়ের সঙ্গে ছেলে শিপন রায় ও রতন রায়
ছবি: সংগৃহীত

জরাজীর্ণ ঘরে কষ্টের জীবন ছিল ফেনীর চরচান্দিয়া গ্রামের গীরু বালা রায়ের। বর্ষায় টিনের ফুটো গলে ঘরে পানি পড়ত। আর শীতে হু হু করে ঢুকত হিমেল বাতাস। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক সময় না ঘুমিয়েই রাত পার করতে হতো। ৬২ বছর বয়সে এসে সেই কষ্ট ঘুচেছে গীরু বালার। ‘মায়ের স্বর্গ’ নামের নতুন বাড়িতে উঠেছেন তিনি। তাঁকে সেই বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন দুই ছেলে—শিপন রায় ও রতন রায়।

শিপন রায় এর আগে একাধিকবার প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম হয়েছেন। শৈশব থেকে অভাবের সংসারে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর জীবন সংগ্রাম নিয়ে ২০২০ সালের ১ আগস্ট ‘মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পাওয়া শিপনের শুধু অভাব আর অভাব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশ পায় ‘চাকরি পেয়েই মায়ের শখ মেটালেন, চড়ালেন বিমানে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন।

এখন শিপন রাজধানীর টিকাটুলী কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। গত শনিবার মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘মায়ের আরেকটি স্বপ্ন পূরণ করলাম।’ সেই সঙ্গে মায়ের জন্য বানানো নতুন বাড়ি এবং সেই বাড়ির সামনে মায়ের সঙ্গে দুই ভাইয়ের তোলা ছবি ও ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালেন।

আমার মা সারা জীবন অনেক কষ্ট করেছেন। তাঁর মুখে খুব কম সময় হাসি দেখেছি। এবার নতুন বাড়িতে পা রেখে মায়ের মুখে যে তৃপ্তির হাসি দেখেছি, সেটা অমূল্য
—শিপন রায়, স্কুলশিক্ষক।  

শিপন জানালেন, ৬২ বছর বয়সে এসে তাঁর মাকে আর কষ্ট করে থাকতে হচ্ছে না—এটাই বড় প্রাপ্তি। গত বছরের ৩০ এপ্রিল নতুন বাড়ি মায়ের স্বর্গতে উঠেছেন তাঁর মা। ছাদ ঢালাই করা একতলা বাড়িটির কাজ তখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। পরে কাজ শেষ করা হয়েছে। বাড়িটি গোলাপি রং করা হয়েছে। বানানো হয়েছে নামফলক। এখন শুধু সেটা ফটকের পাশে লাগানো বাকি আছে। শিপন বললেন, ‘আমার মা সারা জীবন অনেক কষ্ট করেছেন। তাঁর মুখে খুব কম সময় হাসি দেখেছি। এবার নতুন বাড়িতে পা রেখে মায়ের মুখে যে তৃপ্তির হাসি দেখেছি, সেটা অমূল্য।’  

মায়ের জন্য শিপন রায় ও রতন রায়ের বানিয়ে দেওয়া বাড়ি
ছবি: সংগৃহীত

গীরু বালার পাঁচ সন্তান। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। স্বামী স্বপন রায় পেশায় দিনমজুর ছিলেন। অনেক আগেই মারা গেছেন। অন্যের জমি ও বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন গীরু বালা। এক মেয়ে মারা গেছে। অন্যজনকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে দিলীপ রায় বাড়ির পাশেই থাকেন। আলাদা সংসার হয়েছে, কৃষিকাজ করেন। শিপন রায় জীবিকার জন্য রাজধানীতে থিতু হয়েছেন। গীরু বালার আরেক ছেলে রতন রায় থাকেন ওমানে। পেশায় নরসুন্দর তিনি। মায়ের জন্য বাড়ি বানাতে রতনও অর্থ দিয়েছেন।

আরও পড়ুন

১০ বছর বয়সে রিকশা চালানোর মধ্য দিয়ে রোজগার শুরু করেছিলেন শিপন। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে রান্নার তেল, কাঁকড়া, সবজি, মাছ, শুঁটকিসহ নানা জিনিস বিক্রি করেছেন তিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন। ছিলেন নরসুন্দর। এমনকি গোবর দিয়ে লাকড়ি বানিয়েও বিক্রি করেছেন। যুক্ত ছিলেন বর্গা চাষে।

জীবন চালাতে যখন যা করার প্রয়োজন হয়েছে, তখন তা–ই করেছেন শিপন। কিন্তু পড়াশোনা থামাননি কখনো। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন শিপন। এর আগে স্নাতকেও প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন তিনি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিলে ভর্তি হয়েছেন। ২০২১ সালে সরকারি চাকরি হয়ে যায়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রকাশিত ফলাফলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর মায়ের ইচ্ছা পূরণে তাঁকে উড়োজাহাজে চড়ান শিপন। বেড়াতে নিয়ে যান চট্টগ্রামে।

মাকে উড়োজাহাজে চড়ানোর জন্য ওই সময় ধারদেনা করতে হয় শিপনকে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এবারও বাড়ি বানাতে তাঁকে ঋণ করতে হয়েছে। সরকারি চাকরির বেতনের প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধে। তাই চাকরির পাশাপাশি দুটি টিউশনি করছেন। সেই টাকায় মাস চলে তাঁর।

অভাবের সংসারের কথা মনে করে শিপন বলেন, ‘একসময় রাতে খড়ের ওপর পাটি বিছিয়ে গাদাগাদি করে মা আর ভাইবোনদের ঘুমাতে হতো। এখন বাড়িতে আর সেই কষ্ট করতে হয় না। ভাই আর আমি মিলে মাকে নতুন বাড়ি বানিয়ে দিয়েছি। থাকার জন্য চারটি ঘর, রান্নাঘর ও শৌচাগার আছে। সামর্থ্য অনুযায়ী মায়ের অন্যান্য খরচ মেটানোর চেষ্টা করছি।’

মা গীরু বালা রায়ের সঙ্গে শিপন রায়
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন

এখনো বিয়ে করেননি শিপন। মায়ের জন্য বাড়ি বানানোর পর বিয়ে করবেন বলে স্থির করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর বাড়ি বানালে অনেকে ভাবত, শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা এনে মায়ের জন্য বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে শিপন। লোকে যাতে এ কথা বলতে না পারে, সে জন্য আগেই বাড়ি বানিয়েছি।’

অসহায় মানুষের জন্য বড় পরিসরে সেবামূলক কাজ করার আগ্রহ রয়েছে শিপনের। ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছেন একটি সংগঠন। নাম প্যারেন্টস কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল। শিপন জানালেন, এখনো তাঁর ঋণ রয়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ করার পর অসহায় মানুষের জন্য আরও কাজ করবেন তিনি।