‘৩০ বছর মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে, তাই কোটার প্রয়োজন আছে’

সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল আন্দোলন’ ব্যানার নিয়ে যৌথভাবে নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। দুটি সংগঠনেরই কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মো. আল মামুন। চলমান আন্দোলন ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ হাওলাদার

প্রথম আলো:

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বহাল রাখার পক্ষে আপনাদের যুক্তিগুলো কী?

আল মামুন: এখনো হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বেকার অবস্থায় আছেন। অনেকেই পাঁচ-ছয়বার ভাইভা দিয়ে চাকরি পাননি। এ রকম শত শত অভিযোগের প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে সঠিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে হয়তো এখন ৩০ শতাংশ কোটার প্রয়োজন থাকত না। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে বাড়িঘর ও পরিবার হারানো মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের জন্য নির্ধারিত ৩০ শতাংশ কোটার সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সমাজে পিছিয়ে আছে এবং প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

প্রাথমিক বাছাই, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ করার জন্য যথেষ্ট প্রার্থী থাকেন। তারপরও কিছু স্বাধীনতাবিরোধী আমলা ‘কোটায় প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না’ বলে সুকৌশলে শূন্য পদ দেখিয়ে সাধারণ প্রার্থীদের দিয়ে পদগুলো পূরণ করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকাকালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাস্তবায়ন করেনি।

এই দীর্ঘ ২১ বছরে বঞ্চিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স শেষ হওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পর্যন্ত এই কোটাসুবিধা বর্ধিত করেন। আবার ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ বছর বিএনপি-জামায়াত ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটাসুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই মোট ৩০ বছর বঞ্চিত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে তাদের কোটাসুবিধা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার এখনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

প্রথম আলো:

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিলের পাশাপাশি যৌক্তিকীকরণের দাবিও সামনে আনছেন। এ বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী?

আল মামুন: ২০১৮ সালে জারি করা ওই পরিপত্র অবৈধ ও অসাংবিধানিক। এই পরিপত্র জারি সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। মহামান্য হাইকোর্টের রায়ে সেটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাস্তবায়ন শুরু করলে আবার স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার দেখতে পায় যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ষড়যন্ত্রের কারণে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। যৌক্তিক কারণেই তখন এই কোটা নাতি-নাতনি পর্যন্ত বর্ধিত করে ৩০ শতাংশ পূরণ করার চেষ্টা করা হয়। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কোটাসুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে।

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে অন্যান্য কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যে কেউ আন্দোলন করতে পারেন। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছর কোটাসুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে তাদের প্রাপ্য কোটাসুবিধা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার এখনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে৷ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল এবং ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর মুক্তিযোদ্ধা কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করেনি। বিগত ৩০ বছরে লাখ লাখ নিয়োগে বঞ্চিত হওয়া ৩০ শতাংশ কোটা হিসাব করে বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে আমাদের প্রাপ্য ৫ লাখ পদের চাকরি যোগ্যতা অনুযায়ী আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হোক। ৩০ বছরের হিসাব সমাধান করলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বঞ্চিত বেকার ছেলেমেয়েরা চাকরি পাবে। তখন আমরা কোটার সংস্কার মেনে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারি।

এ ছাড়া সংবিধানের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও উত্তরসূরিদের দেশের সব সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের চাকরির নিয়োগে ৩০ শতাংশ কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণ না করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র কখনোই বন্ধ করা যাবে না।

প্রথম আলো:

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার পক্ষে চলমান আন্দোলনকে আপনারা কোন পর্যায়ে নিতে চান?

আল মামুন: বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটূক্তি করে যাচ্ছেন, যা আইনের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট অপরাধ। অবিলম্বে তাঁদের চিহ্নিত করে ছাত্রত্ব বাতিল ও আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ খুব শিগগিরই দেশব্যাপী কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কারণ, কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থীরা সবাই মেধাবী, কেউ অমেধাবী নয়। কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের অমেধাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রাথমিক বাছাই, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কোটা প্রয়োগ হওয়ার কারণে বৈষম্যমূলক ‘মেধা’ শব্দ পরিবর্তন করে ‘সাধারণ’ শব্দ সংযোজন করে সাধারণ প্রার্থী নামকরণ করে সব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।

প্রথম আলো:

শেষ পর্যন্ত দাবি আদায়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?

আল মামুন: দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ আশাবাদী। কারণ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার এবং বঙ্গবন্ধুর উপহার। সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালত অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন। মহামান্য হাইকোর্টের রায়ে ইতিমধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিফলিত হয়েছে। সামাজিক সমতা নিশ্চিত ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে অন্যায়ভাবে বাতিল হওয়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও জেলা কোটা পুনর্বহাল করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব কোটা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের ২০১৮ সালের অবৈধ পরিপত্র বাতিলের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে দেশের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণসমাজ স্বাগত জানিয়েছে। এই বিজয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির বিজয়। প্রশাসনে জামায়াত-শিবিরের প্রবেশ বন্ধ করার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

প্রথম আলো:

কোটা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। আপনাদের ভাষ্য কী?

আল মামুন: আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। কিন্তু কেউ বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করলে তাদের রাজপথে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের অস্তিত্বে কেউ আঘাত করলে আমরা একবিন্দু ছাড় দেব না। কোটা পুনর্বহালের বিষয়ে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি আমরা রাজপথেও সোচ্চার থাকব। কোটা বাতিলের আন্দোলন এখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বাইরে চলে গেছে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আল মামুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।