বটের পাতায় শখের ছবি

গাছের পাতা দিয়ে মোহাম্মদ আরিফের আঁকা চিত্রকর্ম। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়
ছবি-প্রথম আলো

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার একটি স্কুলে শিশুদের ছবি আঁকা শেখান মোহাম্মদ আরিফ (২৫)। শিশুদের কাছে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। কারণ, আরিফ অন্য সবার মতো কেবল পেনসিল আর রংতুলি দিয়ে ছবি আঁকা শেখান না; বরং কাগজ, গাছের পাতাসহ নানা উপাদান ব্যবহার করেন। নিজেও নানা ব্যতিক্রমী মাধ্যমে ছবি এঁকে পরিচিতি পেয়েছেন। বটের পাতা দিয়ে ছবি তৈরি করে এর মধ্যে এলাকায় পরিচিতিও পেয়েছেন তিনি।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘এবিসি মডেল কিন্ডারগার্টেন স্কুল’–এর ছবি আঁকার শিক্ষক আরিফ ২০১৪ সাল থেকে বটের পাতায় ছবি আঁকছেন। চারুকলার কোনো প্রথাগত শিক্ষা পাননি তিনি। নিজের চেষ্টায় এত দূর আসা। শুরুর দিকে বন্ধুবান্ধবের ছবি আঁকতেন। ছবি দেখে সবাই প্রশংসা করতেন, উৎসাহ দিতেন। ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি বটের পাতায় আড়াই হাজার ছবি এঁকেছেন।

সম্প্রতি কুতুবদিয়ায় আরিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দেয়ালে ঝুলছে সারি সারি ছবি। সবই বটের পাতায় আঁকা নানা বিখ্যাত মানুষের। এর মধ্যে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, ফুটবলার লিওনেল মেসি, নেইমার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ নানা খ্যাতিমান মানুষের প্রতিকৃতি দেখা গেল।

একটা বটের পাতায় একজনের ছবি। এমনিতেই বটের পাতা শুকিয়ে গেলে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আরিফের ছবি নষ্ট হয় না, বছরের পর বছর টিকে থাকে। কীভাবে তা সম্ভব? জবাবে এই শিল্পী জানালেন, গাছ থেকে বটের পাতা সংগ্রহ করে প্রথমে তিনি মানুষের ছবি আঁকেন পাতার ওপর। এরপর কাটারের মাধ্যমে পাতা থেকে আঁকা ছবিটি তুলে নেন। তারপর ছবিটি বইয়ের ভাঁজে কয়েক দিন রেখে শুকানো হয়। তাতে পাতা কালো রং ধারণ করে। তখন খয়েরি ও কালো রং মিশিয়ে ছবির প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়। টেকসই ও দীর্ঘ স্থায়ীত্বের জন্য পাতার ছবি লেমিনেটিং করে ফ্রেমবন্দী করেন তিনি।

পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট আরিফ বলেন, ছবি আঁকার পেছনে তাঁর মায়ের উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। বাড়িতে কারও পা পড়লে মা আরিফের আঁকা ছবি দেখাতেন, দোয়া চাইতেন। ২০১৭ সালের ১ জুন মা মনছুরা বেগম মারা যান। তারও আগে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর মারা যান বাবা গোলাম কবির। নানা সংকটের মধ্যেও আরিফ থেমে থাকেননি।

বটের পাতায় ছবি এঁকে সহকর্মী এক শিক্ষিকার হাতে তুলে দিচ্ছেন মোহাম্মদ আরিফ। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়
ছবি-সংগৃহীত

আরিফের আর্ট স্কুল

কুতুবদিয়ার মানুষ এমনিতে সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘ ৪৫ বছর দ্বীপে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ ছিল না। তথ্যপ্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রে এই উপজেলার শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে। প্রতিভা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা ছবি আঁকার সুযোগ পেত না। খুদে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে মোহাম্মদ আরিফ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ছবি আঁকার স্কুল। নাম ‘বর্ণ আঁকা আর্ট স্কুল’। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার দুই ব্যাচে শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। ফি মাসে ১০০ টাকা। গরিব শিশুদের শেখানো হয় বিনা মূল্যে।

২০২১ সালে স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ‘কুতুবদিয়া চারুকলা একাডেমি’ করা হয়। প্রতিবছর ৫০ জন করে শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নেয় এই প্রতিষ্ঠান থেকে। আরিফ যে স্কুলে চাকরি করেন, সেই এবিসি স্কুলের একটি কক্ষে চলে ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ।

প্রতিবছর আরিফের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সেরা হচ্ছে, পুরস্কার পাচ্ছে। আগে অভিভাবকেরা ছবি আঁকা শিখতে শিশুদের পাঠাতে তেমন আগ্রহ দেখাতেন না, এখন সবাই সন্তানদের আরিফের স্কুলে পাঠাচ্ছেন।

ছবি আঁকার স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শেখাচ্ছেন মোহাম্মদ আরিফ। গত শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়
ছবি-প্রথম আলো

শিশুদের প্রিয়মুখ

গত ২১ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৪ উপলক্ষে উপজেলা পরিষদে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তাতে প্রথম স্থান অর্জন করে আরিফের ছাত্রী মাফরুহা কাশমী। সে পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে। মাফরুহা জানায়, আরিফ স্যারের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তার মতো অনেক শিশুই এখন ছবি আঁকায় আনন্দ পাচ্ছে, এটাই বড় কথা।

মাফরুহার মতো অনেক শিক্ষার্থী ছবি এঁকে কৃতিত্ব অর্জন করছে প্রতিবছর। এতে খুশি অভিভাবকেরাও। কুতুবদিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ঝিনুক আক্তার বলেন, আরিফ একজন চমৎকার আঁকিয়ে। শিশুদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি আঁকা শেখান। এ কারণে শিশুরাও সৃজনশীল পরিবেশ পাচ্ছে। বিকাশ হচ্ছে তাদের।

আরিফের বাড়ি বড়ঘোপ ইউনিয়নের রোমাই পাড়ায়। ছবি আঁকার শখ ছোটবেলা থেকেই। এক দশক ধরে তিনি ছবি আঁকছেন। আরিফ বলেন, ছবি আঁকা তাঁর নেশা। মনের অনেক কষ্ট দূর হয়ে যায় ছবি আঁকতে পারায়। ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে একটা বড় আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি।