সাইবার অপরাধের মামলা: উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাঁদের
সাইবার অপরাধের মোট মামলা ৫,৮১৮টি
স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলা ১,৩৪০টি
পাঁচ বছর আগে মেহেদি হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়ার পাশাপাশি ‘জাগো’ নামের একটি ইউটিউবভিত্তিক চ্যানেলে খবর পড়তেন। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি খবর পাঠ করেন তিনি। পরে মেহেদিসহ দুজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন উপমন্ত্রী জ্যাকব। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নয় মাস কারাভোগ করেন মেহেদি। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বিচার শুরু হয় ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর। এরপর থেকে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে চলেছেন মেহেদি। মামলাটি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
মেহেদি হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের দুর্নীতিসংক্রান্ত খবর পাঠ করাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপমন্ত্রীর মামলার পর দিনের পর দিন পালিয়ে ছিলাম। ধরা পড়ার পর ৯ মাস জেলও খাটি। সেই থেকে আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছি। কবে মামলা থেকে মুক্তি পাব জানি না।’
বিরোধী মতের একাধিক রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার অপেক্ষায়।
শিক্ষার্থী মেহেদির ভাষ্য, গ্রেপ্তারের পর আইনজীবীর ফি, যাতায়াতসহ তাঁর পরিবারের খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।
কেবল মেহেদি হাসান নয়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশ সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে সাইবার মামলার আসামি হয়ে বিরোধী মতের একাধিক রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে চলেছেন। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাইবার আইনে দায়ের হওয়া স্পিচ অফেনস-সম্পর্কিত (মুক্তমত প্রকাশের কারণে) মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন সাইবার মামলার আইনজ্ঞরা।
যে আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে, সেই আইন সংস্কার নয়, বাতিল করা উচিত।জেড আই খান পান্না, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তথ্য, যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি) আইন করে। এই আইনের মামলার বিচারের জন্য সাত বছর পর ২০১৩ সালে ঢাকায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপব্যবহার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এরপর ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাসহ চারটি ধারা বাতিল করে। ওই বছরই ডিজিটাল নিরাপত্তা পাস করে সরকার। এই আইনেরও অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে এটি বাতিলের দাবি ওঠে। ২০২৩ সালে আবার এই আইন বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করে বিগত সরকার।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আইসিটি আইনের অনেক ধারা সংবিধানের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যে আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে, সেই আইন সংস্কার নয়, বাতিল করা উচিত।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ১ হাজার ৭১৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে স্পিচ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৬৪। বিচারাধীন এমন অন্তত ২৫টি মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সদস্যদের কটূক্তির জেরে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল।
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, কেবল মতপ্রকাশের কারণে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যাঁদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছিল, সেসব মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করা উচিত।
আইন মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, আইসিটি, ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে গত আগস্ট পর্যন্ত দেশের ৮টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ৫ হাজার ৮১৮টি মামলা চলমান। এর মধ্যে স্পিচ অফেন্স-সম্পর্কিত মামলা মোট ১ হাজার ৩৪০টি। এর মধ্যে তদন্ত চলছে ৪৬১টির। আর ঢাকাসহ দেশের আটটি ট্রাইব্যুনালে ৮৭৯টি মামলার বিচার চলমান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মোট ১ হাজার ৭১৭টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে স্পিচ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ৬৪। বিচারাধীন এমন অন্তত ২৫টি মামলার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও পুলিশ সদস্যদের কটূক্তির জেরে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, ডিজিটাল ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল।
গত এপ্রিলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৪ হাজার ৫২০ জনকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৫৪৯ জনকে। আসামিদের ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ সাংবাদিক। অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি আসামি হয়েছেন; আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছিল ১৯০টি। এসব মামলার বাদী আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা। একই অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও মামলা করেছিলেন।
মামলার খড়্গ মাথায় নিয়ে দিন কাটছে তাঁদের
ফেসবুকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে ওয়ার্কশপের কর্মচারী মোনায়েম ভূঁইয়ার (২৭) বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন মোনায়েম। এরপর ওই বছরের ১৪ আগস্ট তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। আর ১০ মাস কারাভোগের পর ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি কারামুক্ত হন। এরপর ২০২২ সালের ১৫ জুন মোনায়েমের বিচার শুরু হয়। মাসের পর মাস তিনি আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন; কিন্তু সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। সর্বশেষ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের শুনানির তারিখ ছিল গত ২ সেপ্টেম্বর। মোনায়েমের আইনজীবী আমিনুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একটা দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোনায়েম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তির কারণে তাঁকে রিমান্ডে যেতে হয়েছে। নিম্ন আদালতে তাঁর জামিন আবেদন বারবার নাকচ হয়েছে।
মোনায়েমের কৃষক বাবা শুক্কুর আলী ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেকে ধরে নেওয়ার পর থেকে আমরা থানা-আদালত চিনেছি। জামিন করানোর জন্য উকিলের পেছনে অনেক টাকা গেছে। এখনো মামলা ঝুলছে।’
বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দিতে শেখ হাসিনার সরকার আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান হিরো
ফেসবুকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার ব্যঙ্গাত্মক ছবি প্রকাশের অভিযোগে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় ২০১৭ সালের ১২ জুন আশুলিয়ার রাজমিস্ত্রি হাসান আলীকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁর বিরুদ্ধে ওই বছরের ৩১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি অভিযোগ গঠন করেন আদালত। ছয় বছরেও একজন সাক্ষীকেও আদালতে হাজির করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন এই রাজমিস্ত্রি।
হাসান আলীর আইনজীবী মাসুদ খান প্রথম আলোকে জানান, বিতর্কিত ৫৭ ধারা বহু আগে বাতিল হয়েছে; কিন্তু সেই ৫৭ ধারার মামলায় হাজিরা দিয়ে চলেছেন তাঁর মক্কেল। মাসুদ খান আশা করেন, আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাবেন হাসান আলী।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ সাইফুজ্জামান হিরো প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দিতে শেখ হাসিনার সরকার আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সংবিধান পরিপন্থী এসব আইনের জাঁতাকলে বিগত ১৫ বছরে কয়েক হাজার রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, রাজমিস্ত্রিসহ নানা পেশার মানুষ অমানবিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। মতপ্রকাশের জন্য যাঁরা মামলার মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁদের অবিলম্বে রেহাই দেওয়া উচিত বলে মত দেন সাবেক এই বিচারক।
সাইফুজ্জামান হিরো বলেন, কেবল মতপ্রকাশের জন্য মানুষকে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা কিংবা বছরের পর বছর মামলায় হাজিরা দেওয়ার ঘটনা চরম অমানবিক। মতপ্রকাশের পরিপন্থী সাইবার নিরাপত্তা আইনটি পুরোপুরি বাতিল করা উচিত।