ভারতের ভোটের আবহে হঠাৎ আলোচনায় বাংলাদেশ
ভারতে লোকসভার ভোটের আবহে হঠাৎ দুই ভিন্ন কারণে আলোচনায় চলে এসেছে বাংলাদেশ। এভাবে এত দিন ধরে ভারতের প্রায় সব গণমাধ্যমে একসঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা সম্ভবত হয়নি।
কলকাতায় বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যাকাণ্ড কয়েক দিন ধরেই ভারতের সব রাজ্যের খবরের কাগজে জায়গা করে নিচ্ছে। রোমহর্ষ সেই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দারা যখন রহস্যের জট ছাড়াতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় রাজনৈতিক বিতর্কে বাংলাদেশকে টেনে আনলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির (আপ) নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি সরাসরি বলে দিলেন, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতীয় গণতন্ত্রের হাল বাংলাদেশের মতো হয়ে যাবে।
লোকসভা নির্বাচনের ষষ্ঠ দফায় আজ শনিবার ভোট গ্রহণ করা হবে দিল্লির সাতটি আসনে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনে মুক্ত কেজরিওয়াল দিন–রাত এক করে ফেলেছেন সেই ভোটের প্রচারে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে এবারের ভোট–মাহাত্ম্য বোঝাতে গিয়ে তিনি সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, বিজেপি এবারেও যদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে, মোদি যদি আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হন, তা হলে যেটুকু গণতন্ত্র অবশিষ্ট আছে, তা-ও থাকবে না। দেশটা কেমন হয়ে যাবে সেই বর্ণনা প্রসঙ্গেই তিনি টেনে এনেছেন বাংলাদেশের নাম।
শুধু জনসভা বা রোড শোয় অংশ নিয়ে ভাষণেই নয়, সর্বভারতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও কেজরিওয়াল এসব কথা বলেছেন। গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সেখানেও প্রতিবেশী বন্ধুদেশের গণতন্ত্রকে তিনি বসিয়েছেন রাশিয়া ও পাকিস্তানের সঙ্গে এক আসনে।
কেজরিওয়ালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তৃতীয়বারের মতো মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের হাল কী হবে বলে তিনি মনে করেন? জবাবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ওরা সংবিধান বদলে দেবে এবং দেশটা স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাবে। হয় দেশে কোনো নির্বাচনই হবে না, নতুবা রাশিয়ার মতো ভোট হবে, যেখানে পুতিন হয় সব বিরোধীকে কারাগারে পুরে রাখেন, নয়তো মেরে ফেলেন। তারপর নির্বাচন হলে দেখা যায়, তিনি ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন!’ এর পরই কেজরিওয়াল টেনে আনেন বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে দেখা গেল, শেখ হাসিনা সবাইকে (বিরোধীরা) কারাগারে ঢুকিয়ে দিলেন। তারপর বিশাল ব্যবধানে জয়ী হলেন। পাকিস্তানে কী দেখা গেল? তারা ইমরান খানকে কারাগারে পুরল। দল ছারখার করে দিল। প্রতীক কেড়ে নিল; এবং জিতে গেল। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলে ভারতেও এ ধরনের নির্বাচন হবে। গোটা বিরোধীকুলকে কারাগারে বন্দী করা হবে এবং তারা ভোটে জিতবে।’
পাকিস্তান নিয়ে বলা হলেও রাশিয়া ও বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রহীনতা’ নিয়ে ভারতের কোনো শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী আজ পর্যন্ত এমন মন্তব্য করেননি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ভবিষ্যৎ ভারতের সেই ছবিটা কেমন হবে, সেই আন্দাজও কেজরিওয়াল দেন। তিনি বলেন, ‘এবার ওরা আমাকে কারাগারে ঢুকিয়েছে। মণীশ সিসোদিয়াকে (উপমুখ্যমন্ত্রী) বন্দী করে রেখেছে। আমার দলের পাঁচ শীর্ষ নেতাকে কারাগারে আটকে রেখেছে। আমাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে চলেছে। কংগ্রেসের ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করেছিল। হেমন্ত সোরেনকে (ঝাড়খন্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) বন্দী করেছে। এনসিপিকে (মহারাষ্ট্র) ভেঙে দুই টুকরা করে তাদের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। শিবসেনাকেও ভেঙে তাদের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বহু মন্ত্রীকে কারাগারে পুরেছে। একই অবস্থা করেছে তামিলনাড়ুতে স্ট্যালিন সরকারেরও। আমরা যে কীভাবে লড়াই করছি তা আপনারা ভাবতেও পারবেন না।’
আবগারি (মদ) মামলায় অর্থ পাচারের অভিযোগে বন্দী হওয়ার পর বিজেপি কেজরিওয়ালের ইস্তফার দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি; বরং বারবার জানিয়েছেন, পদত্যাগ করবেন না। কেন ওই জেদ, কেজরিওয়াল এই সাক্ষাৎকারে তা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পদের লোভ আমার কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই। আয়কর কমিশনারের পদ ছেড়ে দিয়ে আমি দিল্লির বস্তিবাসীর জন্য ১০ বছর কাজ করেছি। প্রথমবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেছিলাম। আদর্শের জন্যই তা করেছিলাম। কিন্তু এবার করব না। কারণ, এটাই আমার লড়াই।’
কেজরিওয়াল বলেন, ‘বিজেপি জানে, দিল্লিতে আমাকে হারাতে পারবে না। একবার আমরা ৬৭ (মোট আসন ৭০) আসন পাই। পরেরবার পাই ৬২ আসন। তাই তারা আমাকে ফাঁসিয়ে দেয় মিথ্যা মামলায়।’ তিনি বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করলে ওরা সরকার ফেলে দেবে। গণতন্ত্রের পক্ষে তা মারাত্মক। আমি পদত্যাগ করলে ওরা কাল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকেও ফেলে দেবে। পিনারাই বিজয়নের (কেরালা) সরকারকেও। এই লড়াইটাই আমরা লড়ছি। গণতন্ত্রকে ওরা জেলে পুরলে গণতন্ত্রকে জেল থেকেই চালাতে হবে।’
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ২ জুন কারাগারে ফিরে যাওয়ার পর কত দিন তাঁকে সেখানে থাকতে হবে তা একমাত্র প্রধানমন্ত্রীই জানেন। সেই উত্তর শুধু প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আছে।
লোকসভা ভোটের ফল এবার কেমন হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে কেজরিওয়াল বলেন, বিজেপির সম্ভাব্য পতনের তিনটি কারণ রয়েছে। এক. বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধি। মানুষ জেরবার হয়ে রয়েছে। কাজের অভাবে বেকার যুব সম্প্রদায় ঘরে বসে রয়েছে; অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক।
দুই. বিজেপি এবার দল হিসেবে লড়ছে না। বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা আরএসএস সম্পর্কে যা বলেছেন—‘ওদের আর প্রয়োজন নেই।’ তা থেকে স্পষ্টত, আরএসএস এবার বিজেপিকে জেতাতে ময়দানে নামেনি। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উত্তরাধিকারের লড়াই শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী চান অমিত শাহকে তুলে ধরতে; কিন্তু বিজেপির অন্যদের কাছে শাহ গ্রহণযোগ্য নন। অমিত শাহকে এগিয়ে দিতে যেভাবে ওরা বসুন্ধরা রাজে (রাজস্থানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী), শিবরাজ সিং চৌহান (মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) ও রামন সিংকে (ছত্তিশগড়ের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) কোণঠাসা করেছেন, তাতে সবাই ক্ষুব্ধ। এখন ওরা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও সরিয়ে দিতে চাইছে। ক্ষুব্ধ তিনিও।
৩ নম্বর কারণ হিসেবে কেজরিওয়াল স্বৈরতন্ত্রের কথা বলেছেন। কেজরিওয়াল বলেন, ‘এত জায়গায় এত মানুষের মুখে আমি স্বৈরতন্ত্র (তানাশাহি) শব্দটা শুনেছি যে অবাক হয়ে ভেবেছি, বিষয়টা সাধারণ মানুষের মধ্যে গেঁথে গেছে। এই তিন কারণে আমার বিশ্বাস, বিজেপি এবার ২২০টিরও কম আসন পাবে, ‘ইন্ডিয়া’ জোট পাবে তিন শর মতো।’