জাতীয় পর্যায়ে ১০ বারের ‘দ্রুততম মানবী’ ফিরোজা খাতুন। তিনি ক্রীড়ায় ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪’ পেয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় বেসামরিক এই পুরস্কার গ্রহণের পর গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে ফিরোজা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরস্কার পেয়ে তাঁর খুব ভালো লাগছে। মেয়েও তাঁর মতো খেলোয়াড় হতে চায়।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ‘দ্রুততম মানবীর’ পদকগুলো জয় করেছিলেন ফিরোজা। তিনি সর্বশেষ এই পদক পেয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে। ফিরোজা জানালেন, স্বর্ণের পদকগুলো সেভাবে গুছিয়ে রাখেননি তিনি।
জাতীয় পর্যায়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২৪’ বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে ১৮ ক্যারেট মানের ৫০ গ্রাম স্বর্ণের পদক, সম্মানীর অর্থের চেক ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।
ঢাকায় এসে পুরস্কার নিয়ে গতকালই ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে যান ফিরোজা। তিনি জানান, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফিরোজা করিম বারবার তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিভিন্ন ফরম পূরণের জন্য বলে আসছিলেন। মূলত তাঁর অনুরোধেই তিনি এবার এই পুরস্কারের জন্য আবেদন করেছিলেন।
স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য আবেদন করার বিষয়ে ফিরোজা খাতুন বলেন, ‘এটা একটা সিস্টেম (পদ্ধতি)। তবে যাঁদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান আছে, তাঁদের খুঁজে বের করে পুরস্কার দিলে যিনি পুরস্কারটা পাবেন, তাঁর বেশি ভালো লাগবে।’
গতকালের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীরবে-নিভৃতে থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাওয়া নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পুরস্কারে সম্মানিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকালের অনুষ্ঠানে প্রত্যেক বিজয়ীর পাঁচজনকে সঙ্গে নেওয়ার সুযোগ ছিল। ফিরোজা তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র মেয়ে আফনান রোজানা, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইয়ের ছেলে–মেয়ে ও ফিরোজা করিমকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
ফিরোজা খাতুন বললেন, মা এত বড় পুরস্কার পেয়েছেন, তাতে মেয়ে (আফনান) খুশি হয়েছে।
ফিরোজা খাতুন ২০১২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার, ২০২১ সালে রাঁধুনী কীর্তিমতী সম্মাননাসহ বিভিন্ন সময় নানা পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম আলোয় তাঁকে নিয়ে ‘এখনো কাউকে দৌড়াতে দেখলে...’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার পর ফিরোজা তাঁর বাবা আমির উল হকের কথা স্মরণ করলেন।
আলাপে আলাপে ফিরোজা ফিরে গেলেন তাঁর খেলাধুলার সোনালি অতীতে। জানালেন, খেলোয়াড় হবেন, সে ইচ্ছা নিয়ে তিনি ক্রীড়াজগতে আসেননি। ছোটবেলায় তাঁর বাবা তাঁকে দড়ি ধরে লাফ দিতে বলতেন। পার হতে পারলেই পুরস্কার আইসক্রিম। আইসক্রিমের লোভে লাফ দিতে দিতেই উচ্চলম্ফে দক্ষ হয়ে উঠলেন তিনি। তারপর তিনি হয়ে ওঠেন দৌড়বিদ।
ফিরোজার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয়েছিল ঘোড়াশালে। ছোটবেলায় তিনি সেখানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) হয়ে খেলতে গিয়েছিলেন। ১০০ মিটার দৌড়ের জন্য সেদিন সেখানে কোনো মেয়ে উপস্থিত ছিল না। কর্মকর্তারা ফিরোজাকে দৌড়াতে বলেন। পুরস্কার না পেলেও কর্মকর্তাদের চোখে পড়েন ফিরোজা। তারপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। খেলার জগতে বেশি সময় দেওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডি এইচএসসির পর আর এগোয়নি ফিরোজার।
ফিরোজার বাবা ও মা মারা গেছেন। তিন বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বড় বোন মারা গেছেন। ফিরোজা বর্তমানে ময়মনসিংহে বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রোলার স্কেটিং একাডেমির সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি।
ফিরোজা বলেন, তিনি একদিন স্বাধীনতা পুরস্কার পাবেন, এই বিশ্বাস তাঁর ছিল। তবে তাঁর পথ মসৃণ ছিল না। খেলাধুলার জন্য লোকের কটূক্তি শুনতে হয়েছে তাঁকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যখন ট্রাউজার পরে খেলতে বের হতাম, তখন চারপাশ থেকে নানা কথা শুনতে হতো। মাথা নিচু করে চলতাম।
ভাবতাম, ফলাফলের মাধ্যমেই একদিন এসবের জবাব দেব। মানুষের কটূক্তির জবাব দিতেও পেরেছিলাম।’
ফিরোজা খাতুন জানান, ‘একসময় খেলাধুলা নিয়ে তাঁর বাবা ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরাও আপত্তি করেছিলেন। পাড়ায় অনেকে কথা শোনাত। তবে সেসব পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন তিনি। এখন একমাত্র মেয়েকে নিয়ে যখন রাস্তায় বের হন, মেয়ের খেলার পোশাক নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। পরিস্থিতি পাল্টেছে।’
ফিরোজা হাসতে হাসতে বললেন, ‘এখন যে মেয়েরা খেলতে আসে, তাদের বলি, তোমরা খেলার জন্য যে তৈরি মাঠ ও পরিবেশটা পেয়েছ, তাতে কিন্তু আমার অবদান আছে। আমি বা আমার মতো অন্যরা তোমাদের খেলার রাস্তাটাকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন। কঠিন সময়কে জয় করতে পেরেছিলাম বলেই এখন মেয়েরা খেলতে পারছে।’
ফিরোজা এখন স্বপ্ন দেখছেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। তাঁর স্বপ্ন, একদিন মায়ের মতো খেলোয়াড় হবে মেয়ে।
ফিরোজা বললেন, ‘মেয়েও আমার মতো খেলোয়াড় হতে চায়। মেয়ে ক্রিকেট বেশি পছন্দ করে। মাঝে মাঝে মায়ের মতো দৌড়বিদও হতে চায়। মেয়ের যেটা পছন্দ, তা–ই হবে। শুধু তাকে বলেছি, যেকোনো একটা লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোতে হবে। একসঙ্গে অনেক কিছু হতে চাইলে সেভাবে কোনো কিছুই হওয়া যায় না।’
খেলাধুলায় দেশের মেয়েরা কতটুকু এগিয়েছে, এ প্রসঙ্গে ফিরোজা বলেন, ‘আগে আমরা খেলা নিয়ে যেমন সারা বছর মাঠে থাকতাম, এখন মেয়েরা সেভাবে মাঠে থাকতে পারছে না। পড়াশোনার চাপ আছে। অভিভাবকদের ইচ্ছার অভাবের পাশাপাশি স্কুলগুলোও সেভাবে সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক, কারও মধ্যে খেলার তীব্র ইচ্ছে থাকলে একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে যায়।’
ময়মনসিংহে মেয়েদের খেলাধুলার পরিস্থিতি নিয়ে ফিরোজা বললেন, মেয়েরা অন্য খেলার চেয়ে ক্রিকেট খেলায় বেশি আগ্রহী। ফলে অন্য খেলায় মেয়েদের উপস্থিতি কম। দলবদ্ধ খেলায় সবাই উপস্থিত না থাকলে তার সুফল পাওয়া যায় না।
ফিরোজা বললেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন খেলায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের উপস্থিতিই বেশি।
খেলতে গেলে শুধু প্রশিক্ষণ দিয়ে ছেড়ে দিলেই হবে না। যাতায়াতে ভাড়া লাগে। ভালোমন্দ খেতে হয়। খেলা শেষে মেয়েরা কী খাবে, তা নিয়ে চিন্তা করলে খেলাটাই হবে না। তাই খেলায় মেয়েদের উপস্থিতি বাড়াতে হলে সরকারকেই উদ্যোগটা নিতে হবে।
ফিরোজার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে মেয়েদের জন্য একটি একাডেমি চালু করার। যে একাডেমি থেকে মেয়েরা সব ধরনের খেলার সুযোগ পাবে। তবে আবার তিনি সেই একই কথা বললেন, সরকারের সহায়তা পাওয়া না গেলে খুব একটা সামনে এগোনো সম্ভব না।
খেলাধুলায় এখনো মেয়ে–ছেলে খেলোয়াড়ের মধ্যে বৈষম্য আছে বলে উল্লেখ করেন ফিরোজা। তিনি বলেন, খেলা এমন একটি বিষয়, যেখানে ছেলে বলে বেশি পরিশ্রম করবে, আর মেয়েরা কম পরিশ্রম করবে, তার কোনো উপায় নেই। সফল হতে হলে ছেলে ও মেয়েকে সমান পরিশ্রম করতে হয়। বরং মেয়েদের নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তাই খেলাধুলায় এই বৈষম্য দূর হবে, এটাই চাওয়া তাঁর।
বিভিন্ন কাজের মধ্য থেকে আনন্দ খুঁজে নিতে হয়—এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী ফিরোজা। তিনি বললেন, ‘মেয়েদের খেলার ব্যাপারে সবার আগে পরিবারকে উদার হতে হবে। একটি মেয়ের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারের সহায়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’