বিচারক নিয়োগে অনাচার হয়েছে, প্রতিটি বিষয়ে নজর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে: আইন উপদেষ্টা
সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনাচার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, শুধু উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অনাচার হয়। আপিল বিভাগের দেওয়ার ক্ষেত্রে অনাচার হয়, বেঞ্চ গঠনের ক্ষেত্রে অনাচার হয়, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে অনাচার হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি বিষয়ে নজর দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৪’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সেমিনার হলে ওই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়।
আইন উপদেষ্টা বলেন, উচ্চ আদালতকে মানবাধিকার হরণ, মানুষকে নির্যাতন করার একটা হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের প্রচণ্ডভাবে ক্ষমতাশালী করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটা যদি নষ্ট করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের যেকোনো দমনমূলক (রিপ্রেসিভ) সরকার এসে মানবাধিকার দমন করার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়। এই কাজটাই গত ১৫ বছরে করা হয়েছে।
হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক ও আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশের জন্য প্রধান বিচারপতিকে চেয়ারম্যান হিসেবে রেখে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ নামে স্থায়ী একটি কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে খসড়া অধ্যাদেশে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ খসড়া অধ্যাদেশ অনুসারে, হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগযোগ্য ক্ষেত্রে কাউন্সিলের সদস্য হবে আট, হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারকের ক্ষেত্রে কাউন্সিলের সদস্য হবে পাঁচ এবং আপিল বিভাগের ক্ষেত্রে কাউন্সিলের সদস্য হবে তিনজন। কাউন্সিলে প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের প্রবীণতম দুজন বিচারপতি, আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি (অন্য বিচারক সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রধান বিচারপতি নির্ধারণ করবেন), অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং আইনের অধ্যাপক থাকবেন বলে খসড়ায় এসেছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, খাদিজাকে (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী) বিচার ছাড়াই জেলে রাখার জন্য আপিল বিভাগ দিনের পর দিন জামিন শুনানি পেছানো হয়েছিল। জঘন্য সব ঘটনা ঘটেছে। এই উচ্চ আদালতের অনাচার, আদালত ব্যবস্থার মাধ্যমে নিপীড়ন-নির্যাতনের সবচেয়ে সমস্যাসংকুল বিধানটা হচ্ছে আদালতের বিচারক নিয়োগ আইন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উচ্চ আদালতে এমন বিচারক নিয়োগ পেয়েছে, যে নিম্ন আদালতে বিচারক হওয়ার পরীক্ষায় ফেল করেছে। উচ্চ আদালতের এমন বিচারক আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেছে।’
আলোচকদের মতামতের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রত্যেকে একটা কথা অভিন্নভাবে বলেছেন, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ ভালো হতে হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে।...উই ডু ইট (আমরা এটা করব)।
মতবিনিময় সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘দলীয় রাজনীতির মুখপাত্ররা যেন বসে না পড়ে, রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের কিছু নেই। যদি দলীয় রাজনীতির মুখপাত্ররা আসতে না পারে, সেটিও নিশ্চিত করা একটা বড় কাজ।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কাউন্সিলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি রাখা প্রশংসনীয়, একই সঙ্গে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহসভাপতিকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়, তাহলে কাউন্সিল আরও সমৃদ্ধ হবে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রত্যাশী ব্যক্তি আবেদন করে বিচারক হবেন—এর বিরোধিতা করি। কেননা ভালো আইনজীবী ও ব্যক্তিত্ব আছেন, তাঁরা আবেদন করবেন না।’
সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, আবেদন দেওয়ার (বিচারক হতে) জন্য প্রক্রিয়া রাখা হয়েছে। এটি ভালো হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাতিসংঘে যখন বিভিন্ন নিয়োগ হয়, সেখানে আবেদন দেওয়ার সুযোগ থাকে। শুধু যারা চোখে পড়ছে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের শুধু তারাই না, যারা নিজেদের যোগ্য মনে করছে, তারাও চেষ্টা করতে পারছে। আর নিয়োগের আগে ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করছে কি না—এগুলো বোঝার জন্য তাদের বৃত্তান্ত সংক্ষিপ্ত আকারে জনসমক্ষে আসা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই বছরের জন্য নিয়োগ, কিন্তু এই নিয়োগ দুই বছর পর কনফার্ম (স্থায়ী) করতে হবে—এ কথা কোথাও বলা নেই। সংবিধানে সুযোগ আছে, দুই বছরের আগে কনফার্ম করার। খসড়া আইনে এই সুযোগটা নেই। যে সুযোগটা ছিল, তা যেন রদ না করি।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতিকে বাইরে রাখতে হবে। পেশাজীবী সংগঠন কোনোটাই রাজনীতির বাইরে নেই। বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, তাঁরা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হন। এটা যদি হয়, তাহলে তিনি কতটুকু পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবেন? কাউন্সিল থেকে পেশাজীবী পরিষদ বাইরে রাখা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব শেখ আবু তাহের।
অন্যদের বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামীম হাসনাইন ও বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. শাহজাহান সাজু এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল প্রসিকিউটোরিয়াল অ্যাডভাইজার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও এহসান এ সিদ্দিক। এর আগে খসড়া অধ্যাদেশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মারুফ আল্লাম।