রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন ইলমা জাহান। মা–বাবার স্বপ্ন ছিল, মেয়ে চিকিৎসক হবে। আর ইলমা চাইতেন, এইচএসসির পর হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন, না হয় প্রকৌশলে পড়বেন। তাঁদের এসব স্বপ্ন–চাওয়া এখন অতীত। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছেন মেয়েটি।
মেয়ের এই অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না ইলমার মা মাকসুদা আক্তার জাহান ও বাবা মো. ইকবাল কবির। আজ মঙ্গলবার দুপুরে যখন তাঁদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়, তখন কথার শুরুতে দুজনই বলেন, ‘ইলমার মা–বাবা বলছি।’
এ সময় মাকসুদা আক্তারের কান্নায় মুঠোফোনে আর্তনাদ ছাড়া কোনো কথাই স্পষ্ট বোঝা গেল না। বাবা ইকবাল কবির কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মেয়েটা তো সময়ই দিল না। হুট করেই চলে গেল। এখন ওর মাকে সামলানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
ইকবাল কবির জানান, গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) ঈদুল আজহার দিন বিকেলে ইলমার জ্বর আসে। এক দিন বাদে শনিবার তার রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তখন তার রক্তে প্লাটিলেট (অনুচক্রিকা) ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার। পরদিন রোববার পরীক্ষায় প্লাটিলেট কম পাওয়া গেলে রাত ১০টায় ইলমাকে আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মেয়েটি মারা যায়।
ইকবাল কবির আরও জানান, ইলমা মারা যাওয়ার পর প্রথমে ঢাকার মালিবাগের বাসায় জানাজা হয়। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ইলমার মা, বাবা ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একমাত্র বড় ভাই এখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই।
ইকবাল কবির হাসপাতালে মেয়ের সঙ্গেই ছিলেন। বললেন, ‘সময় আর পাইলাম কই? ওই দিন নিজেই হেঁটে বাসা থেকে নেমে গাড়িতে উঠল, আবার গাড়ি থেকে নেমে নিজেই হেঁটে হাসপাতালে উঠল। সকালে খিদে লেগেছে বলার পর নার্স স্যুপ দিতে চেয়েছিলেন। মেয়ে তার মা স্যুপ নিয়ে আসবে জানিয়ে হাসপাতালের স্যুপ খেতে চায়নি। আমি হাসপাতালের ক্যানটিন থেকে স্যুপ এনে খাওয়াই, বলি মা আনার পর আবার খেয়ো। কিন্তু মেয়ে মায়ের হাতের স্যুপ আর খেতে পারল না। মা স্যুপ নিয়ে আসতে আসতেই মেয়েটা চলে গেল!’
গতকাল সকালে মারা যাওয়ার আগে ইলমার বাবা ইকবাল কবিরকে জানিয়েছিলেন তাঁর তলপেটে ব্যথা করছে। একটু পর মেয়ে জানায়, পেটব্যথা একটু কমেছে। তখন মেয়েকে ঘুমাতে বলেন। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই মেয়ে অস্থির হয়ে যায় জানিয়ে ইকবাল কবির বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় তার রক্তচাপসহ সব কিছু এলোমেলো দেখাতে থাকে। মেয়েটা বুক জ্বলছে বলে। খিঁচুনি শুরু হয়। তখন তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরপর সে আর কোনো কথা বলতে পারেনি।’
ব্যাংকে কর্মরত ইকবাল কবির বলেন, ইলমার মা যখন হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসেন, ততক্ষণে সব শেষ। কিন্তু ওই মুহূর্তে মেয়ে নেই এই খবর মেয়ের মাকে জানানো সম্ভব ছিল না। তাঁকে জানানো হয়, মেয়ের চিকিৎসার জন্য অন্য জায়গায় নেওয়া হয়েছে। দুজন আত্মীয়ের সঙ্গে মেয়ের মাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে দুপুরে জানানো হয় মেয়ে আর নেই।
পরিবারটির আক্ষেপের শেষ নেই। ইকবাল কবির বললেন, মেয়ের শারীরিক যন্ত্রণা হচ্ছিল। হয়তো ভেবেছিল আনারস খেলে একটু ভালো লাগবে। আনারস খেতে চাইল। কিন্তু সেই আনারস খাওয়ানোরও তো সময় দিল না মেয়েটা।
ইকবাল কবির জানান, তাঁরা মালিবাগে ১০ তলা ভবনের ৯ তলায় থাকেন। বাসায় মশার উৎপাত নেই। তবে মেয়ে কোচিং করত সিদ্ধেশ্বরীতে। কলেজে যাওয়া–আসা ছিল। তাই কোথায় মশায় কামড়িয়েছে, তা বলার উপায় নেই।
এই বাবা বললেন, ‘মেয়ে নেই, আমি আর কাকে দোষ দেব? আমাদের কপালে ছিল। মেয়েটা নেই, তা তো কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মেয়েটা স্কাউট, বিএনসিসি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা—কত কিছু যে করত। ঈদের আগের দিন নিজে সুন্দর করে হাতে মেহেদি দেয়, অন্যদের দিয়ে দেয়। মায়ের হাতেও মেহেদি লাগিয়ে দেয়। মেয়েটা আমাদের অনেক আদরের ছিল। সেই মেয়েই আমার নাই হয়ে গেল!’
ইলমা জাহানের মৃত্যুতে ফেসবুকে নূন বাতায়ন নামের একটি গ্রুপে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ভিকারুননিসা পরিবারের পক্ষে শোক প্রকাশ করেছেন।