শরীর পুড়েছে, পা হারিয়েছেন—স্বপ্ন পূরণে হার মানেননি তানজিলা
ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে। এর মধ্যে বাসার গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন তানজিলা আক্তার। ডাকনাম শিলা। দেখা হতেই হাসলেন। ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বললেন, ‘আজ ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছ করা হচ্ছে। ঘর এলোমেলো হয়ে আছে।’ এ নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখা হলো তানজিলার সঙ্গে।
তানজিলার বয়স ২১ বছর। পরিবারের সঙ্গে থাকেন রাজধানীর পশ্চিম রামপুরায় উলন বাজারের কাছে একটি বাসায়। ১০ বছর আগের ঘটনা। বাসার কাছে এক শিক্ষকের বাসায় পড়তে গিয়েছিলেন তানজিলা। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে তিনি দগ্ধ হন। মুখমণ্ডলসহ শরীরের বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায় তানজিলার।
একপর্যায়ে তানজিলার ডান পা কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। তবে দমে যাননি তিনি। হাজার কষ্ট সয়েও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তানজিলা।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তানজিলা। সরকার পরিবর্তনের পরে সড়কে যখন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না, তখন যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যায় তাঁর বড় বোন রুমা আক্তারের মেয়ে আশরাফী (৭)।
তানজিলাদের বাসা সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পরপর কয়েকটি ঘর। মাঝখানে একচিলতে উঠান। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় কেউ কেউ রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলেন। উঠানে দড়িতে ঝুলছিল ভেজা কাপড়। সারিবদ্ধ ঘরগুলোর একটিতে মা আর বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন তানজিলা। ভাড়া মাসে পাঁচ হাজার টাকা। রান্নাঘর আর শৌচাগার অন্য ভাড়াটেদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়।
ঘরের ভেতরে একটিমাত্র খাট। সেটির জায়গা বদল করা হচ্ছিল। এ জন্য বিছানাপত্র তুলে রাখা হয়েছে। মোড়ায় বসেই কথা হলো তানজিলা আর তাঁর মা রোকেয়া বেগমের (৫৫) সঙ্গে। ভাই মাসুদ রানা (২৩) রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি চালান। তাঁর আয়েই টেনেটুনে সংসার চলে।
রোকেয়া বেগম জানান, বছর তিনেক ধরে তানজিলার বাবা মনির হোসেন আলাদা বসবাস করছেন। তখন থেকে সংসারে অনটন আরও বেড়ে গেছে।
চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে পরিবারের। সংসার চালাতে ভাইয়ের ওপর চাপ পড়ছে। আমি উপার্জন করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই। কিন্তু এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি, পড়ালেখা না করলে আমাকে কেউ মর্যাদা দেবে না, কোনো চাকরিও পাব না। তাই পড়ালেখা কখনো ছাড়তে চাই না।
ধার করে ফরম পূরণ
তানজিলা এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছেন গুলশান কমার্স কলেজ থেকে। বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৪ পেয়েছেন তিনি। পরীক্ষার ফলাফলের কথা তুলতেই খানিকটা মন খারাপ করলেন। বললেন, পারিবারিক ঝামেলার মধ্যে বহু কষ্টে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু এসএসসির সঙ্গে মূল্যায়নের ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারণ করায় ফল প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। এসএসসিতে তিনি জিপিএ-৩.৯৪ পেয়েছিলেন।
কথায় কথায় জানান, টাকার অভাবে এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারছিলেন না। কলেজে ১০ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। সব মিলিয়ে ভেবেছিলেন পরীক্ষাই দিতে পারবেন না। পরে এক জায়গা থেকে ১৩ হাজার টাকা ধার করে এনে ফরম পূরণ করেন। বকেয়া পরে পরিশোধ করে দিতে বলেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এখন এইচএসসি পাসের সনদ তুলতে হলে এই টাকা পরিশোধ করতে হবে।
হঠাৎ সবকিছু বদলে যায়
চার বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তানজিলা। তাঁর ভাষায়, তাঁদের পারিবারিক অবস্থা আগে এতটা খারাপ ছিল না। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে তাঁর জীবনই শুধু কঠিন হয়ে ওঠেনি; পরিবারও ঋণের ধাক্কায় পড়ে গেছে।
রোকেয়া বেগম বললেন, ওই ঘটনার (সিলিন্ডার বিস্ফোরণ) সময় তিনিও অসুস্থ ছিলেন। সবে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। তাঁর একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল।
তানজিলা বললেন, ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালের ৭ নভেম্বর। তখন তাঁর বয়স ছিল ১১ বছর। স্কুলের পরীক্ষা ছিল। তিনি ও ভাগনি আশরাফী কাছেই স্যারের বাসায় পড়তে গিয়েছিলেন। নিচতলার কক্ষে স্যার তাঁদের বসিয়ে রেখে বের হওয়ামাত্র গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে তিন মাস থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। ডান পায়ে সংক্রমণ হলে পা ঊরু থেকে কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। এরপর দীর্ঘ সময় নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হয়েছে। এর মধ্যে একবার কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছিল। তবে অস্ত্রোপচারের জায়গায় কোনো একটা সমস্যা থেকে সেটা বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেননি।
তানজিলা বলেন, পরে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা শুরু করেন তিনি। এখন আর চিকিৎসক দেখিয়ে নতুন করে কৃত্রিম পা লাগানোর সংগতি নেই।
প্রতিদিনের লড়াই
তানজিলা জানান, ক্রাচে ভর দিয়ে লোকাল বাসে উঠে নিয়মিত কলেজে যাতায়াত করেছেন। একদিন বাসে ওঠার পর বাসচালকের সহকারী চালকের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী উঠতাছে।’ এ নিয়ে তানজিলা বলেন, বাসে ওঠার পর দেখি ‘মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত’ আসনেও জায়গা নেই। তখন ক্ষোভ নিয়ে বলি, ‘প্রতিবন্ধীও বলেন। আবার বসারও জায়গা দেন না।’
‘কখনো কখনো চলার পথে এ ধরনের আচরণে কষ্ট হয়। সবার চোখে আমি অসুস্থ। কিন্তু আমি নিজেকে সুস্থ বলে মনে করি,’ এমনটাই বলছিলেন তানজিলা।
গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তানজিলা। সরকার পরিবর্তনের পরে সড়কে যখন ট্রাফিক পুলিশ ছিল না, তখন যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে অনেকের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।
ফুটবলে ভুলে থাকেন দুশ্চিন্তা
এর আগে ৮ অক্টোবর তানজিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি অ্যাম্পুটি ফুটবলার হিসেবে একটি প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছিলেন। তখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ১৩ জন নারী অ্যাম্পুটি ফুটবলারের সঙ্গে তানজিলা রাজধানীর ফকিরাপুলের একটি আবাসিক হোটেলে ছিলেন। সেখানেই কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।
অঙ্গহানি হয়েছে—এমন নারী-পুরুষদের জন্য পাঁচ দিনব্যাপী ফুটবল প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)। ওই আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ অ্যাম্পুটি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (বাফা), ওয়ার্ল্ড অ্যাম্পুটি ফুটবল ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)।
দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই প্রথম নারী অ্যাম্পুটি ফুটবল আয়োজন। প্রশিক্ষক ছিলেন ওয়ার্ল্ড অ্যাম্পুটি ফুটবল ফেডারেশনের ব্রিটিশ কোচ হ্যারি স্মিথ। বাফুফের কৃত্রিম টার্ফে ১০ অক্টোবর প্রদর্শনী ম্যাচ হয়। এর আগে শ্রীমঙ্গলে ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তানজিলারা ফুটবল প্রশিক্ষণ নেন।
ফুটবল ম্যাচ নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত ছিলেন তানজিলা। নিজেকে অ্যাম্পুটি ফুটবলার হিসেবে পরিচয় দিতে তাঁর ভালো লাগে। নিজের মধ্যে কিছু একটা করার আত্মবিশ্বাস পান। বিস্ফোরণের সেই দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়। তবে ফুটবল খেলা তাঁর চিন্তাভাবনাকে পাল্টে দিয়েছে। তানজিলা বলেন, ‘আমি ভাবতাম, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি যে এক পায়ে ফুটবল খেলা যায়। খেলার সময় সব বেদনা, দুশ্চিন্তা ভুলে যাই।’
পড়াশোনা ছাড়তে চান না
ফেরার সময় তানজিলা বলেন, ‘আমার চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়েছে পরিবারের। সংসার চালাতে ভাইয়ের ওপর চাপ পড়ছে। আমি উপার্জন করে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাই। কিন্তু এটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি, পড়ালেখা না করলে আমাকে কেউ মর্যাদা দেবে না, কোনো চাকরিও পাব না। তাই পড়ালেখা কখনো ছাড়তে চাই না।’
তানজিলা সম্পর্কে পরিচিতজনদের বক্তব্য, ‘মেয়েটা গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে পারে।’
তানজিলার কণ্ঠেও নিজের প্রত্যাশা আর স্বপ্ন পূরণ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের রেশ টের পাওয়া যায়। আগুন তানজিলার শরীর পোড়ালেও, পা কেড়ে নিলেও স্বপ্ন নিঃশেষ করতে পারেনি। তাঁর প্রত্যাশা, পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন পূরণের পথে যেন শক্তি ও ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন।