সেরা সংকলন, অনন্য সূচনা

ভাষা আন্দোলনের ঘটনা নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে মানুষকে। এর গভীর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী ইতিহাসে। এই আন্দোলনের আবেগ স্ফুরিত হয়েছে সাহিত্যে, গানে, চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রে। কবিতা ও কথাসাহিত্য থেকে গবেষণা পর্যন্ত পৌঁছেছে এর প্রেরণা। এখানে রইল ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত একটি বইয়ের আলোচনা।

হাসান হাফিজুর রহমানের (১৯৩২-১৯৮৩) ‘সংগঠকসত্তার শ্রেষ্ঠ ফসল’ একুশের সাহিত্যের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারী। এর প্রকাশক ছিলেন পুঁথিপত্র প্রকাশনীর পক্ষে মোহাম্মদ সুলতান (১৯২৬-১৯৮৩)। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমিনুল ইসলাম, রেখাঙ্কন করেছেন মুর্তজা বশীর ও অন্যান্য। এখন আমরা জানি, এই ‘অন্যান্য’ ছিলেন আসলে বিজন চৌধুরী। প্রথম প্রকাশ মার্চ ১৯৫৩। পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯০। মূল্য দুই টাকা আট আনা।

সংকলনটির চতুর্থ প্রচ্ছদে মুদ্রিত রয়েছে গ্রন্থটি প্রকাশের অভিপ্রায়, ‘একুশের চৈতন্য সারা দেশে ব্যাপ্ত। আলাদা করে এ কারো নয়, তেমনি কাউকে বাদ দিয়েও এ নয়। সারা দেশের শিরায় শিরায় এমন অগ্নিপ্রভ স্রোত বুঝি আর হয় না, মাতৃভাষার প্রেরণা ছাড়া এমন দোলা বুঝি মানুষের আর কখনো লাগে না।

একুশে ফেব্রুয়ারী

সম্পাদক: হাসান হাফিজুর রহমান

পুঁথিপত্র প্রকাশনী, ঢাকা; মার্চ ১৯৫৩

‘রক্ত দিয়ে আমরা প্রতিটি হৃদয় এই আত্মদর্শনকে অর্জন করেছি; রক্তের অক্ষরে আমাদের প্রতিটি সাহিত্যিক এই মহাগাথাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাই সারা দেশে একুশের কাহিনী আবেগে অমোঘ, বিশ্বাসে অনন্য।

‘এই অনন্যতার বাইশটি প্রতিলিপি এঁকেছেন এই গ্রন্থে—গল্পে, প্রবন্ধে, নকশায়, নাটকে, কবিতা আর গানে বাইশটি শক্তিমন্ত হাত। আমাদের দেশের কোনো সাহিত্যিক এত আগ্রহে বুঝি আর কিছু কখনো লেখেননি; কখনো এত একান্ত করে বুঝি কিছু অনুভবও করেননি। তাই এ সংকলন এমন বিশ্বাসের দুর্লভ নিদর্শন, যার নিদর্শন ইতিহাসেও দুর্লভ।’

কুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সংস্করণে ‘একুশের প্রবন্ধ’, ‘একুশের কবিতা’, ‘একুশের গল্প’, ‘একুশের নকশা’, ‘একুশের গান’, ‘একুশের ইতিহাস’ শিরোনামে ৬টি বিভাগে মোট ২২ জন লেখকের লেখা মুদ্রিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে ৪ পৃষ্ঠার একটি সম্পাদকীয় রচনা।

কুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সংস্করণের পুরো সূচিপত্র: ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ (সম্পাদকীয়); প্রবন্ধ: আলী আশরাফা—সকল ভাষার সমান মর্যাদা। একুশের কবিতা: শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও হাসান হাফিজুর রহমান। একুশের গল্প: শওকত ওসমান—মৌন নয়, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ—হাসি, আনিসুজ্জামান—দৃষ্টি, সিরাজুল ইসলাম—পলিমাটি, আতোয়ার রহমান—অগ্নিবাক। একুশের নকশা: মুর্তজা বশীর—একটি বেওয়ারিশ ডায়েরির কয়েকটি পাতা, সালেহ আহমেদ—অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত স্বাক্ষর। একুশের গান: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেন। একুশের ইতিহাস: কবিরউদ্দিন আহমদ।

হাসান হাফিজুর রহমানের জীবদ্দশায় চারটি, তাঁর মৃত্যুর পর একটিসহ একুশে ফেব্রুয়ারীর মোট ৫টি সংস্করণ (দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫; তৃতীয় সংস্করণ মে ১৯৬৮; চতুর্থ সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ ও পঞ্চম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫) প্রকাশিত হয়। 

একুশে ফেব্রুয়ারী প্রথম প্রকাশের ১২ বছর পর ‘পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত’ আকারে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। দ্বিতীয় সংস্করণে ১২টি নতুন লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়। একুশের কবিতা অংশে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্​দার আবু জাফর, মাহবুব তালুকদার ও আল মাহমুদ; প্রবন্ধ অংশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আহমদ শরীফ ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; একুশের গান অংশে জসীমউদ্​দীন ও আবদুল লতিফ—তাঁদের রচনা সংযোজিত হয়। এ ছাড়া নতুন শিরোনামে ‘একুশের নাটক’ অংশে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ ও ‘একুশের ঘটনাপঞ্জি’ অংশে খোন্দকার গোলাম মুস্তাফার ‘যেন ভুলে না যাই’ যুক্ত হয়েছে। তৃতীয় সংস্করণে আরও ৪টি নতুন রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একুশের কবিতা অংশে বেগম সুফিয়া কামাল; প্রবন্ধ অংশে ড. আনিসুজ্জামান ও সন্তোষ গুপ্ত এবং একুশের গান অংশে ইন্দু সাহার রচনা যুক্ত হয়েছে। চতুর্থ সংস্করণে কোনো নতুন লেখা যুক্ত হয়নি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ মিলিয়ে যুক্ত হওয়া নতুন লেখার সংখ্যা ১৬টি। নতুন যুক্ত হওয়া রচনাগুলো একুশে ফেব্রুয়ারীকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছে।

তবে বিস্ময়, গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণে সৈয়দ শামসুল হকের একুশের কবিতাটি বাদ পড়া। কেন বাদ দেওয়া হলো, তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। কেউ কেউ প্রশ্নও তুলেছেন, একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃত সংকলনে এ ধরনের ‘পরিবর্তন ও পরিবর্ধন’ যুক্তিযুক্ত কি না। আরও একটি তথ্য আমাদের বিস্ময়ের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়, তা হলো একুশে ফেব্রুয়ারীর পরবর্তী সংস্করণগুলোর সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। সংযোজন–বিয়োজন সবই করেছেন প্রকাশক নিজেই।

কুশে ফেব্রুয়ারীর পঞ্চম সংস্করণটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তিনটি অংশে বিন্যস্ত এটি, সম্পাদনা করেছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফয়েজ আহমদ ও আনিসুজ্জামান। এই সংস্করণের প্রথম অংশে একুশে ফেব্রুয়ারীর আদি সংস্করণ; দ্বিতীয় অংশে পরবর্তী সংস্করণসমূহে সংযোজিত রচনাসমূহ এবং তৃতীয় অংশে ফয়েজ আহমদ, মোহাম্মদ সুলতান, কামাল লোহানী, গাজীউল হক ও এম আর আখতার মুকুলের লেখা যুক্ত হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তৃতীয় সংস্করণে যুক্ত হওয়া সুফিয়া কামালের একুশের কবিতা ও ইন্দু সাহার একুশের গান বতর্মান সংস্করণে বাদ পড়েছে। প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি পঞ্চম সংস্করণের সম্পাদনার সময় একুশে ফেব্রুয়ারীর তৃতীয় সংস্করণটি সম্পাদকমণ্ডলী দেখার সুযোগ পাননি?

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটি বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জীবনে আজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রকাশের একুশ দিন পর তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে এবং পুঁথিপত্র প্রকাশনীর অফিসে পুলিশি হামলা চালায়।

১৯৫৩ সালে অমর একুশে একুশে ফেব্রুয়ারী নামের সংকলনটি সম্পাদনার মধ্য দিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান একুশের সংকলন প্রকাশের যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিলেন, তা আজও অব্যাহত রয়েছে। দ্বিধাহীনভাবে বলা যেতে পারে, একুশে ফেব্রুয়ারীই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত একুশের সংকলনগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছে।

বাঙালির শহীদ দিবস এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে বিশ্ববাসী পালিত হচ্ছে। বিশ্বের বিপন্নপ্রায় ভাষাভাষীর মাতৃভাষা রক্ষার দাবি নিয়ে দিবসটি প্রতিবছর আমাদের সচেতন হতে প্রেরণা জোগায়। আজ থেকে একাত্তর বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারীর মাধ্যমে আমাদের পূর্বসূরিরা উচ্চারণ করেছিলেন: ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই।’

লেখক: গবেষক।