সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বলছে, স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনের পরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে দলটির ৩১ দফায়। এর মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তৈরি করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দফা রয়েছে। এ ছাড়া গণমাধ্যম কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে বিএনপির ৩১ দফায়। ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি কয়েক দফায় রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাব দেয়। হাসিনা সরকারের বাধার মুখে বিএনপির ৩১ দফার প্রচারণা ছিল দলটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কয়েকটি সেমিনার-কর্মশালায় সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি বিএনপি নতুন করে বিভাগ ও জেলাগুলোতে ৩১ দফার প্রচারণা শুরু করেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধান সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির ৩১ দফায় উল্লেখিত কিছু কমিশনও রয়েছে।
হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের যে ফ্যাসিস্ট রাজনীতি ছিল, তার পতনের পর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের বশংবদ হতে গিয়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনটি রাজনৈতিক শক্তি—বিএনপি, জামায়াত ও নাগরিক কমিটি সামনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিএনপি ৩১ দফায় তাদের সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরেছে। নাগরিক কমিটি ও জামায়াত—এই দুই রাজনৈতিক শক্তির সংস্কার প্রস্তাব ও আলোচনায় আসা দরকার। ক্ষমতায় গেলে জামায়াতের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-চীনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি মেনে চলবে, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রশ্নে তারা কী অবস্থান নেবে, ব্যাংকিং খাতে কী পরিবর্তন আসবে, শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তাদের অবস্থান কী ইত্যাদি বিষয়েও দলটিকে স্পষ্টভাবে বলতে হবে।
অন্যদিকে নাগরিক কমিটি সংবিধান সংস্কার কমিশনকে ৬৯টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দফা রয়েছে। বিএনপি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শাসনের মধ্যেই তাদের সংস্কার প্রস্তাবের কথা বলেছে, নতুন করে রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তন যে প্রয়োজন, তা উপলব্ধি করেছে। বিএনপির সংস্কার প্রস্তাব ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। তাই জুলাই-আগস্টের নির্বিচার হত্যা ও হাসিনা সরকারের পতনের আগেই রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তারা উল্লেখ করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যেসব রাজনৈতিক শক্তি গঠিত হয়েছে, তাদের যেমন জুলাইয়ের চেতনাকে ধারণ করতে হবে, তেমনি রাষ্ট্র গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়াকেও বুঝতে হবে।
রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সংস্কার করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া, সংস্কারের উদ্দেশ্যে সুপারিশ তৈরি করা স্বল্প সময়ের মধ্যে হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশনগুলো এ লক্ষ্যে সুপারিশমালা তৈরি করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামোতে সংস্কার আনার যে প্রক্রিয়া, তা নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলোকেই করতে হবে। নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের ওপরে আস্থা রাখা মানে জনগণের রায়ের ওপরে আস্থা রাখা। যদি নাগরিক সমাজ ও অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের পর যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের ওপরে সংস্কারের জন্য আস্থা রাখা যায় না, তবে সেই অনাস্থা জনগণের রায়ের ওপরেই অনাস্থা হবে। যে রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হবে, তারা যদি দেশ শাসনের মতো বৃহত্তর বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পায়, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার কেন তারা করতে পারবে না?
গণতন্ত্রের শক্তি সামষ্টিকতায়, আর সৌন্দর্য ভিন্নমতে। যদি নাগরিক সমাজ ও শিক্ষার্থী নেতাদের একটি অংশ মনে করে যে দেশের সব ভোটারের সামষ্টিক ম্যান্ডেটের চেয়ে তাদের বিচার-বিবেচনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা শুধু দুঃখজনকই নয়, পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকারের মতবাদেরই প্রতিফলন। জনগণ যে রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারের জন্য যোগ্য মনে করবে, তাদের হাতেই দায়িত্ব তুলে দিতে হবে। সামষ্টিক শক্তির প্রতি এই শ্রদ্ধা দেখানোর পর যদি নির্বাচিত ক্ষমতাসীন দল তাদের ওপরে দেওয়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণ তাদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার প্রয়োগ করবে। এভাবে সামষ্টিকতা ও ভিন্নমতের ভারসাম্যের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের জয় হবে।
সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংস্কার। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, নির্লজ্জ দলীয়করণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার, সর্বোপরি শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির উত্থান—সবকিছুর মূলে রয়েছে নিয়মবহির্ভূতভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা। পাঁচ বছর পরপর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এর কোনোটাই এমন মাত্রায় ঘটত না। জুলাই গণহত্যার পটভূমিও তৈরি হতো না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু কোনো রাজনৈতিক দলের দাবি নয়; বরং বাংলাদেশের সব জনগণের নিজেদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার একমাত্র উপায়। যদি আমরা সংস্কার নিয়ে সত্যিই আগ্রহী হই, তবে আমাদের উচিত সুষ্ঠু নির্বাচনকে ত্বরান্বিত করা, পিছিয়ে দেওয়া নয়।
দ্রুত নির্বাচন করা দরকার বেশ কিছু বাস্তবসম্মত কারণে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছে, এখন এই সমর্থন নিম্নমুখী। জনগণ স্বভাবতই শাসনক্ষমতায় থাকা সরকারের সমালোচক হয়। হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এবং নির্বিচার হত্যার প্রতিবাদে নানা শ্রেণি, পেশা ও মতের মানুষের ঐক্য হয়। জিনস, টি–শার্ট আর বোরকা পরা তরুণীরা পাশাপাশি আন্দোলন করেন। ডান-মধ্যম-বাম—সব ধারার মানুষ এক হন। কিন্তু ‘কমন এনিমি’ বা ‘সবার শত্রু’ হাসিনার পতনের পরই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকার পতিত স্বৈরাচারের বশংবদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা ও আমলাদের বিরুদ্ধেও শক্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই। দেশের ভেতরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা অপপ্রচার শুরু হয়। গত ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত মুডি’স রেটিং অনুযায়ী, বৈদেশিক বিনিয়োগেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের অবনমন হয়।
লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ মোশতাক খানের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ক্লায়েন্টেইলিস্ট, অর্থাৎ ক্লায়েন্ট-প্যাট্রন সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডেভিড জ্যাকম্যানের গবেষণায়ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ইনফরমাল নেটওয়ার্ক’-এর (অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক)–এর গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। নীতিগত বিবেচনায় এ ধরনের রাজনীতির আমরা বিরোধিতা করতে পারি, কিন্তু বাস্তবিকতার বিবেচনায় আমাদের মানতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের নেটওয়ার্কই পুরো দেশব্যাপী স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। তাই দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও গণতান্ত্রিক চর্চা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরই অনেকখানি নির্ভরশীল। নাগরিক কমিটি বা অন্য কোনো নতুন শক্তি যদি এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে চায়, তবে তা রাজনৈতিকভাবেই আনতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকারের সহায়তায় ও রাষ্ট্রীয় আনূকূল্যে রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতায় যেতে চাইলে তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী হবে। গণতন্ত্রের মূল শক্তি জনগণ। তাই জনগণের সম্পৃক্ততাই যেকোনো রাজনৈতিক দলকে গ্রহণযোগ্যতা দেবে। আর সেই গ্রহণযোগ্যতা মাপার মাপকাঠি হচ্ছে
সুষ্ঠু নির্বাচন।
ড. সাইমুম পারভেজ: ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ের শিক্ষক