ফিরে দেখা
প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান: ‘স্যার’ হতে চাইলেন না রবীন্দ্রনাথ
১৯১৯ সালের ৩০ মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া নাইটহুড উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কী ঘটেছিল এর আগে—এসব নিয়েই এবারের ফিরে দেখা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলাভাষী মানুষ ‘কবিগুরু’ বা ‘বিশ্বকবি’ এভাবেই সম্বোধন করে থাকেন। তাতে কবির প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা যেমন প্রকাশ পায়, আপন মানুষ হিসেবেও নৈকট্যের অনুভূতি জাগে। সে তুলনায় তাঁকে ‘স্যার রবীন্দ্রনাথ’ বলতে বা শুনতে কেমন লাগত! ‘স্যার’–এর সঙ্গে মান-মর্যাদার প্রকাশ যতটা আছে, তেমনি আছে একধরনের সীমারেখা টানা দূরত্ববোধ। উপাধিটি ভারতে একান্তই বাণিজ্য করতে এসে রাজ্য দখল করে প্রভু বনে যাওয়া ব্রিটিশদের দেওয়া বিধায় তাতে কিছুটা কর্তৃত্বময় ভীতিও জড়িত। যা হোক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যে ‘স্যার’ বলতে হচ্ছে না, সে ব্যবস্থা কবি নিজেই করে গেছেন। আজ তাঁর সেই প্রতিবাদী প্রত্যাখ্যানের ১০৫তম বার্ষিকী।
১০৪ বছর ধরেই বহুবার আলোচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রিটিশ উপাধি ‘নাইটহুড’ তথা ‘স্যার’ প্রত্যাখ্যানের ঘটনা। তাই সবারই জানা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের দেওয়া খেতাব। এই রচনা কেবল শতাধিক বছরের অতীত থেকে কবির সেই একক প্রতিবাদের ঘটনা স্মৃতির আলোয় ফিরিয়ে এনে আবারও স্মরণ করার জন্য। হয়তো এ ঘটনা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে কাউকে, এমন আশাও করা যায়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ জায়গাটি পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের কাছে, শিখদের পবিত্র স্বর্ণমন্দির যেখানে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল সেখানে বৈশাখী উৎসবে অংশ নিতে সমবেত হয়েছিলেন ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো মানুষ। শিখ, হিন্দু, মুসলিম সবাই ছিলেন। তাঁদের মধ্যে শিশু আর নারী ছিলেন অনেক। এ উপলক্ষে তাঁরা সেদিন তাঁদের দুই নেতা সত্য পাল ও সাইফুদ্দিন কিচলুকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।
জায়গাটির চারপাশ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। প্রবেশপথ ছিল মাত্র দুটি। তার একটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অপর পথটি দিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার সেনাবাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে নিরস্ত্র মানুষের ওপরে গুলির নির্দেশ দেন। নারকীয় অবস্থার সৃষ্ট হয়েছিল। হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল বিপুল। সেখানে কিছু কূপ ছিল। পানির উৎস। গুলি করা ছাড়াও অনেক মানুষকে সেই কূপে ফেলে তাঁদের ওপর পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছিল। গুম করা হয়েছিল অনেক মৃতদেহ।
ব্রিটিশ সরকার পরে তাদের লোক দিয়েই এ ঘটনার জন্য একটি তদন্ত কমিটি করেছিল (ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও তাদের দেখানো সেই পথ এখনো আমাদের দেশে অনুসৃত হয়। কোনো দুষ্কর্ম ঘটলে তার জন্য তদন্ত কমিটি করা হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকদের নিয়েই)। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, গুলি চলেছে ১ হাজার ৬৫০টি। প্রাণ হারিয়েছেন ৩৯৭ জন, আর আহত এক হাজার। অবশ্য বেসরকারি উদ্যোগেও একটি তদন্ত হয়, যাতে প্রাণহানির সংখ্যা ন্যূনতম এক হাজার বলা হয়েছিল।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বড় রকমের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বহির্বিশ্বে। এতে ব্রিটিশ শাসকদের বর্বরতার মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে। তবে এরপর ভারতের জনসাধারণের ওপর ব্রিটিশ শাসকদের কঠিন নির্যাতন নেমে আসে। সামরিক আইন জারি করা হয়। বিনা কারণে লোকদের প্রকাশ্যে রাস্তায় পেটানো, চাবুক মারা, হাতে-হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে বাধ্য করা, বেয়নেট চার্জ, সামনে বা পেছন থেকে গুলি এমনকি নারী ও পুরুষদের নগ্ন করে দিবালোকে রাস্তা দিয়ে ঘোরানোর মতো বর্বরতা ঘটিয়েছেন সুসভ্য ব্রিটিশরা! এসবই ইতিহাসের সাক্ষী।
ব্রিটিশরা অবশ্য জেনারেল ডায়ারের কাজে খুব খুশি ছিলেন। ডায়ারের জীবনী নিয়ে একটি বই লিখেছেন নাইজেল কলেট। ‘বুচার অব দ্য অমৃতসর’ নামের সেই বইয়ের বরাত দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে (১৭ মে ২০১৬) উল্লেখ করা হয়েছিল যে তদন্ত কমিশনের কাছে ডায়ার বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি যা করেছি ভালো করেছি। দ্বিতীয়বার স্পর্ধা দেখানোর আগে তারা একবার ভাববে।’ লন্ডনবাসীও মনে করেছিলেন ডায়ার তাঁর কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করেছেন। এই বীর সেনানায়কের সংবর্ধনার জন্য তাঁরা তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাতে উঠেছিল ২৬ হাজার পাউন্ড। সেই টাকায় দামি রত্নখচিত এক তরবারি তাঁকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। তাতে খোদাই করে লেখা হয়েছিল ‘সেভিয়ার অব পাঞ্জাব’। তিনি নাকি পাঞ্জাবের রক্ষাকর্তা।
কবিগুরু জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছিলেন দেরিতে। ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ, ছবি, তথ্য সবকিছু প্রকাশ তারা বন্ধ করে দেয়। পাঞ্জাবে অন্য এলাকার লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লোকের মুখে আর বিদেশি গণমাধ্যমের কিছু খবরাখবর মানুষ জানতে পেরেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তখনকার পরিস্থিতির ওপরে একটু নজর বুলিয়ে নেওয়া যায়। ব্রিটিশদের জন্য খুব উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার সময় চলছিল। মনে সাম্রাজ্য হারানোর ভয় ধরেছিল তাদের। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভারতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে, ব্রিটিশদের এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ভারতীয় সেনারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দূরে থাক, যেসব ভারতীয় সৈনিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চরম দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক সংকট নেমেছিল জনজীবনে। অপর দিকে আবার মহামারি লেগেছিল। মানুষের মনে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠছিল।
নিবর্তনমূলক আইন ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ তো ছিলই, উপরন্তু জনতার ক্ষোভ দমন করতে ‘অ্যানার্কিক্যাল অ্যান্ড রেভল্যুশনারি ক্রাইমস অ্যাক্ট’ নামে আরেকটি কালো আইন করা হয়, যা ‘রাউলাট অ্যাক্ট’ নামে পরিচিত। এ আইনের বলে যখন ইচ্ছা, যেখান থেকে, যে কাউকে কোনো কারণ ছাড়াই তুলে নিয়ে যাওয়া, গ্রেপ্তার করা, আটকে রাখা, কোনো প্রমাণ ছাড়াই কেবল সামান্য সাক্ষ্যে বিচার করে বন্দী রাখা এমনকি দ্বীপান্তরে পাঠানোর মতো ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ শাসকেরা। এই কালো আইনের প্রতিবাদ হচ্ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। জাতীয় কংগ্রেস দলের নেতা মহাত্মা গান্ধী ভাবছিলেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের। সিপাহি বিপ্লবের কথা স্মরণে ছিল ব্রিটিশদের। তাঁরা ভয় পেয়েছিলেন আবার না প্রবল বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠেন ভারতবাসী। টলে যায় তাঁদের ক্ষমতার মসনদ। ফলে বেপরোয়াভাবে তাঁরা রাউলাট অ্যাক্টের প্রয়োগ করছিলেন। ব্যাপক ধরপাকড় হচ্ছিল। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সব ধরনের সভা–সমাবেশ। এ জন্যই জালিয়ানওয়ালাবাগের বৈশাখ উৎসবের সমাবেশে নির্বিচার গুলি চালিয়েছিলেন তাঁরা।
কবিগুরু জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছিলেন দেরিতে। ব্রিটিশ সরকার সংবাদপত্রের ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সংবাদ, ছবি, তথ্য সবকিছু প্রকাশ তারা বন্ধ করে দেয়। পাঞ্জাবে অন্য এলাকার লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। লোকের মুখে আর বিদেশি গণমাধ্যমের কিছু খবরাখবর মানুষ জানতে পেরেছিলেন। কবি তখন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁর শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। তাঁর কানেও হয়তো এভাবেই উড়ো উড়ো কিছু কথা এসেছিল। তবে মোটামুটি একটা ধারণা পান ২১ মে। কবিগুরু খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। কোনো কিছু করার প্রবল তাড়নায় তিনি বলতে গেলে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর লেখালেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে তিনি আর শান্তি বোধ করছিলেন না। অসুস্থ শরীরেই কলকাতা ছুটে আসেন। রানু অধিকারীকে চিঠি লিখে তাঁর অন্তর্বেদনার কথা জানিয়েছেন। জ্বর প্রবল হয়ে উঠেছিল। চিকিৎসকেরা পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর মন শান্ত হচ্ছিল না। এতগুলো নিরস্ত্র মানুষ, শিশু ও নারীকে এমন নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা তিনি মানতেই পরছিলেন না।
কবিগুরু সিদ্ধান্ত নেন, এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। ভেবে ঠিক করলেন তিনি দিল্লি গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর দুজনে সেখান থেকে পাঞ্জাবে যাবেন প্রতিবাদ জানাতে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ও তাঁর গুণমুগ্ধ ধর্মযাজক চার্লস অ্যান্ড্রুজকে দিল্লি পাঠালেন মোহনদাস কমরচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু প্রচণ্ড হতাশ করলেন তাঁকে কবির বন্ধুবর মহাত্মা গান্ধী। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করার রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব স্রেফ নাকচ করে দিয়ে অ্যান্ড্রুজকে সাফ জানিয়ে দিলেন, এ নিয়ে কিছু বলে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করতে চান না। রবীন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিতে বললেন, এখন এসব বলার সময় আসেনি। অ্যান্ড্রুজ ফিরে এসে কবিকে যখন গান্ধীজির বয়ান শোনালেন, তখন নাকি কবি বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ওই সব খ্যাতি–উপাধির তাঁর কোনো দরকার নেই। তিনি শুধু চেয়েছিলেন ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক।’
গান্ধী অসম্মত হলেও কবি হতোদ্যম হলেন না। কলকাতা থেকেই প্রতিবাদ করার কথা ভাবলেন। বিখ্যাত রাজনীতিক কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার, স্বরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বহু বিখ্যাত রাজনীতিকের গুরু এবং বেঙ্গল প্যাক্টের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কবির সুহৃদ। তাঁর কাছে নিজেই ছুটে গিয়ে প্রতিবাদী সভা করার প্রস্তাব দিলেন। দেশসুদ্ধ সব মানুষ এত বড় অনাচার মুখ বন্ধ করে সহ্য করবে, তা কী করে হয়! চিত্তরঞ্জন যেভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, সেটি শুধু দায় এড়ানোর নয়, বেশ মজারও। কবি চিত্তরঞ্জনকে বলেছিলেন দলীয়ভাবে প্রতিবাদী সভা ডাকতে। তিনি বললেন, সভাপতিত্ব কে করবে? কবি জানালেন তিনি নিজেই সভাপতিত্ব করতে প্রস্তুত। চিত্ত জানতে চাইলেন, তাহলে বক্তব্য কে দেবেন। কবি বললেন, সেটা তাঁরাই ঠিক করুন। চিত্ত বললেন, কবি স্বয়ং যখন সভাপতি তখন আর অন্যের কথা বলার থাকবেই বা কি? কবি তা–ও মানলেন। জানালেন বেশ, কেবল তিনিই বলবেন। তবু সভা আহ্বান করা হোক। তখন নাকি ব্যারিস্টার সাহেব বন্ধুবর কবিকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজেই যখন সভাপতি, আপনিই বক্তা, তখন নিজেই সভাটি ডাকুন।’ আইন ব্যবসায়ীর কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী হয়ে কবি ও কথাশিল্পী আর কথা না বড়িয়ে পা বাড়িয়েছিলেন বাড়ির পথে (স্মর্তব্য: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে শোকাভিভূত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।)।
কবিগুরু সিদ্ধান্ত নেন, এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে হবে। ভেবে ঠিক করলেন তিনি দিল্লি গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর দুজনে সেখান থেকে পাঞ্জাবে যাবেন প্রতিবাদ জানাতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যকে প্রেরণা দিয়ে বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে...।’ নিজেই কি তিনি নিজের কথার অন্যথা করবেন! রবীন্দ্রনাথ তা পারেন না। সবাই ফিরিয়ে দিলে কবিগুরু নিজ কর্তব্য স্থির করে নিলেন। ১৯১৯ সালের ২৯ মে সারা রাত ধরে একটি পত্র রচনা করলেন। সকালে সেই চিঠি পড়তে দিলেন (বিশিষ্ট বিজ্ঞানী) প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে। তারপর সকালে চার্লস অ্যান্ড্রুজ এলে স্যার উপাধি প্রত্যাখ্যানের সেই চিঠিটি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে ছিলেন যথাস্থানে পৌঁছে দিতে। চিঠি পড়ে তাঁরা বলেছিলেন, ‘প্রতিবাদের ভাষা খুব তীব্র হয়েছে, খানিকটা মোলায়েম করে কি পুনর্লিখন করা যায় না।’ এবার কবির অসম্মতির পালা। সুহৃদের পরামর্শে কর্ণপাত করেননি তিনি।
কবিগুরুর এই নাইটহুড প্রত্যাখ্যান তখন বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বড় রকম প্রভাব ফেলেছিল জনগণের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব ও আন্দোলনে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সুহৃদ অমল হোমকে (সাহিত্যিক ও সাংবাদিক) লেখা চিঠিতে বলেছিলেন—‘দেশের বেদনার মধ্যে আমরা যেন নতুন করে পেলাম রবি বাবুকে। এবার একা তিনিই আমাদের মুখ রেখেছেন।’ তবে বিপক্ষেও বলেছিলেন কিছু লোক। খোদ গান্ধী পর্যন্ত মন্তব্য করেছিলেন, কবির সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী হয়নি। গান্ধীজি অবশ্য পরবর্তী সময়েও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো কাথা বলেননি। ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মহাত্মার এ বিষয়ে নীরবতার সমালোচনা করেছেন। এমনকি এমনও বলেছেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। মহাত্মা যদি তখন আন্দোলনের ডাক দিতেন, তবে ভারতের স্বাধীনতার জন্য আরও অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করতে হতো না। তবে এমন মন্তব্য অনুমানমাত্র। বাস্তবতা আর অনুমান অনেক ক্ষেত্রেই এক রকম হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজনীতি সচেতন ছিলেন; তবে তিনি সরাসরি মহাত্মা বা দেশবন্ধুর মতো মাঠের রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন কবি। রাজনীতির জন্য যাঁরা বহু খ্যাতি ও উপাধিতে ভূষিত, তাঁরা সেদিন ওই ঘৃণ্য বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া দূর অস্ত মুখফুটে একটি বাক্যও উচ্চারণ করতে সাহসী বা সম্মত হননি। কবির ওই রকম কোনো উপাধিও ছিল না। ব্রিটিশরা তাঁকে যে খেতাব দিয়ে নিজেরা ধন্য হতে চেয়েছিলেন, সেটি তিনি প্রবল ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা–শঙ্কা করেননি। তিনি বলেছিলেন, ওই সব খ্যাতি–উপাধির তাঁর কোনো দরকার নেই। তিনি শুধু চেয়েছিলেন ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক।’
আমাদের রবীন্দ্রনাথকে আমাদেরই মতো আমজনতার জন্য ব্যথিত হয়ে মহার্ঘ্য বলে বিবেচিত নিজের খেতাব তুচ্ছজ্ঞানে প্রত্যাখ্যানের এই সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনে আবারও এক স্তবক সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। #