সাম্প্রতিক সময়ে ভিন্নমতে অসহিষ্ণু বাংলাদেশে বলিষ্ঠ ও সাহসী উচ্চারণের জন্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বর্তমানে কমবেশি সবাই চেনেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও জাতীয় রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার এমন উদাহরণ বিরল।
তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশ হাসপাতাল গড়ার কাহিনি অনেকেই জানেন। একাত্তরের দিনগুলি এবং মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইয়ে তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার কাহিনি এবং বাংলাদেশ হাসপাতালে তাঁর অবদানের বিবরণ রয়েছে। তবে অনেকেই, বিশেষ করে তরুণেরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এবং বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য খাতে তাঁর অবদানের কথা বিশেষ একটা জানেন না। তাঁর প্রয়াণের পর সে কথা জানাতেই এই নিবেদন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ডা. জাফরুল্লাহ তাঁর অসমাপ্ত এফআরসিএস পূর্ণ করার জন্য বিলাতের জীবনে আর ফিরে যাননি। মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী ও বিপ্লবী।
শহুরে তরুণদের মধ্যে যখন একটু একটু করে হতাশা আসছে, তখন তিনি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর। তাঁর স্বপ্নপূরণে সাহায্য ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর গণস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসছেন বন্ধু ডা. মাহমুদুর রহমানের মা, কর্নেল এম এম হক এবং আরও অনেক তরুণ—মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ হাসপাতালের দিনগুলোয় যাঁদের অনেকে ছিলেন একসঙ্গে।
২০১৫ সালে আমাদের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, শুরুতে তাঁর মাথায় ছিল বাংলাদেশেও বিলাতের মতো জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) প্রতিষ্ঠা করার ভাবনা, যেখানে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব নাগরিক সমান মানের স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি বিশেষায়িত সেবাও পাবেন। যখন তিনি বুঝলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান জনবল আর সম্পদ দিয়ে সে রকম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন, তখন তিনি তাঁর কৌশল পাল্টালেন; কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলেন না।
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ হাসপাতালের অভিজ্ঞতায় তিনি গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার নারী কর্মী বাহিনী, যাঁদের কাজের এলাকা গ্রামে। সেই সত্তরের দশকে নারীদের সাইকেল ও মোটরগাড়ি চালানো এবং নিরাপত্তাকর্মসহ নানা পেশায় প্রশিক্ষিত করেছেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল, যেখানে চিকিৎসা হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের রেফার করা রোগীদের। মানুষের জন্য চালু করেছেন স্বাস্থ্যবিমা, যে বিমার প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয় আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্যই প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা এ দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার স্বাস্থ্য অধ্যায়ে স্বাস্থ্যবিমার উল্লেখ ছিল। কিন্তু সেটা করে দেখিয়েছেন ডা. জাফরুল্লাহ। সব মিলিয়ে তাঁর দাঁড় করানো গণস্বাস্থ্যের মডেলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৫ সালে নিবন্ধ প্রকাশিত হলো বিশ্বের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট পত্রিকায়।
১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আটা ঘোষণায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার যে চারটি মডেল তুলে ধরা হয়েছিল, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ছিল সেগুলোর অন্যতম। এসব তথ্য বাংলাদেশের অনেক এমপিএইচ ডিগ্রিধারীরাও জানেন কি না, সন্দেহ।
সাশ্রয়ী সেবামূল্যের জন্য গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল খ্যাতি পেয়েছে ‘কাজের লোকের’ হাসপাতাল হিসেবে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের অংশীদারত্বে এখানেই গড়ে উঠেছে ডায়ালাইসিস করার বিশাল এক ইউনিট। এর সেবামূল্য আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।
এমন সেবামূল্যে দিনে ৩০০ জন কিডনি রোগীকে সেবা দেওয়ার সামর্থ্য ও উদাহরণ পৃথিবীর আর কোনো হাসপাতালে আছে কি না, আমার জানা নেই। গণবিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ—এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক সেমিস্টার গ্রামে থাকা এবং গ্রামে গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেওয়া বাধ্যতামূলক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে তরুণদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে, তা তিনি হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন।
‘ধূমপায়ীদের আবেদন করার দরকার নেই’—ডা. জাফরুল্লাহ তাঁর প্রতিষ্ঠানে এমন নিয়ম চালু করার ৩০ বছর পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টির মর্ম অনুধাবন করেছে। ওষুধের দাম সহনীয় রাখলে এবং সহজলভ্য করলে মানুষের পকেটের খরচ কমবে—এসব আমরা ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস থেকে সাম্প্রতিককালে জানি। আশির দশকেই তিনি তা জানতেন বলেই সাশ্রয়ী দামে জেনেরিক নামে ওষুধ বিপণনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস।
মুক্তিযুদ্ধ, হাসপাতাল, গণবিশ্ববিদ্যালয়, দেশ গড়া—এসব বাদ দিয়েও বাংলাদেশের ওষুধশিল্প গড়ে ওঠার পেছনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদানকে স্বীকার করতেই হবে। ১৯৮২ সালে যখন ওষুধনীতি প্রণীত হয়, তখন বাংলাদেশের ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশ ছিল আটটি বহুজাতিক কোম্পানির দখলে।
অপ্রয়োজনীয় ওষুধে বাজার ছিল পরিপূর্ণ। ৮৫ শতাংশ ওষুধই আমদানি করতে হতো। তাঁর ওষুধনীতির কারণে সব অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়; নানা প্রকার নীতি সহায়তা দিয়ে দেশি কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনে উৎসাহিত করা হয়। এ কারণে আশির দশক থেকে বাংলাদেশ ওষুধ নিয়ে স্বস্তিতে আছে।
আজ দেড় শতাধিক দেশে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ওষুধ রপ্তানি করে। ওষুধশিল্প আজ প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার, তথা ৩৬ হাজার কোটি টাকার শিল্প! বহুজাতিক কোম্পানির দাপট নেই বললেই চলে। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে ঋণী।
তৈরি পোশাকশিল্পের পথিকৃৎ নুরুল কাদের খানের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও স্বীকৃতি জানিয়ে বিজিএমইএ তাদের ভবনে মিলনায়তনের নাম রেখেছে নুরুল কাদের খানের নামে। অথচ বাংলাদেশের ওষুধশিল্প মালিকদের কিংবা স্বাস্থ্য খাতের কোনো সংগঠন আজ পর্যন্ত প্রকাশ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
সম্প্রতি এক সম্মাননা সভায় স্কয়ার গ্রুপের কর্ণধার খোলাখুলি বলেছেন, সে সময়ে ওষুধনীতির বিরোধিতা করলেও আজ তাঁরা বোঝেন যে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প দাঁড়িয়ে আছে যুগান্তকারী ওষুধনীতিরই কারণে। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি। আমরা আশা করব, স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এ ধারা অব্যাহত থাকবে। আর তাতে শামিল হবে স্বাচিপ, ড্যাব এবং বিএমএ।
খায়রুল ইসলাম: ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক