‘বর্ষা জরিপে’ এডিসের লার্ভাচিত্র শঙ্কার

  • ঢাকার দুই সিটির ৫৬টি ওয়ার্ডে লার্ভাচিত্র আশঙ্কাজনক

  • সেপ্টেম্বর–অক্টোবরের অস্বাভাবিক বৃষ্টিকে দুষছে সিটি করপোরেশন

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশাফাইল ছবি: রয়টার্স

ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশার লার্ভা (শূককীট) জরিপ হওয়ার কথা ছিল বর্ষাকালে। কিন্তু বর্ষা শেষে শরৎ হয়ে হেমন্তকালও যাওয়ার পথে। এ সময় এসে ‘বর্ষার জরিপ’ করেছে সরকার। আর তাতে দেখা গেছে, ডেঙ্গুর এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি গত বছরের বর্ষাকালসহ আগের দুই জরিপের চেয়ে বেশি; যা আশঙ্কাজনক পর্যায়ের। এ জরিপ করা হয়েছে ঢাকার দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়।

কীটতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ সময়ে এসে এত লার্ভা পাওয়ার চিত্র বলে দিচ্ছে, দুই সিটি করপোরেশন আসলে মশা নিধনে তেমন কোনো কিছু করছে না। যা করছে, তা ভুলভাবে করছে। এখন এত লার্ভা পাওয়ার অর্থ হলো, শীতের মধ্যেও ডেঙ্গুর প্রকোপ সহজে যাবে না।’

ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে এডিস মশার জরিপ হয় প্রতিবছর তিনবার—বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে। এডিস মশার ঘনত্ব দেখে আগাম ধারণা পাওয়া যায়, ডেঙ্গুর প্রকোপ কতটুকু হবে। এসব জরিপ হয় মূলত ঢাকার দুই সিটিসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশনে। তবে এবার বর্ষা মৌসুম পার হয়ে যাওয়ার পরও ডেঙ্গুর বর্ষাকালীন জরিপ না হওয়ায় এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৪ থেকে ১৩ নভেম্বর ‘বর্ষার জরিপ’ শেষ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে রাজধানীতে এডিস মশার জরিপ হয় প্রতিবছর তিনবার—বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে।

জরিপে যা পাওয়া গেল

বর্ষার সময় জরিপ না হওয়ায় এবারের এই মধ্য–নভেম্বরের জরিপকেই বর্ষার জরিপ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান এ জরিপের নেতৃত্বদানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তানজিনা আক্তার।

বরাবর এ জরিপ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। কিন্তু এবার তা করে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন জটিলতায় এবারের বর্ষার জরিপ হয়নি। জরিপের প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিও পাল্টে গেছে।’

এবারের জরিপ হয় ঢাকার দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের ৩ হাজার ১৩৪ পরিবারের ওপর। লার্ভা জরিপে যে বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটি হলো লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ করা। এ ক্ষেত্রে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। যদি এই ইনডেক্সের পরিমাণ ২০–এর বেশি হয়, তবে তা আশঙ্কাজনক বলে বিবেচিত হয়।

এবারের জরিপে দেখা গেছে, ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে দুই সিটির ৫৬টি ওয়ার্ডেই বিআই ২০–এর ওপরে। এর মধ্যে আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৫টি ওয়ার্ড এবং উত্তর সিটির ২১ ওয়ার্ড। এবার দুই সিটির গড় বিআই ২২ দশমিক ৭১। এর মধ্যে দক্ষিণের বিআই ২৫ দশমিক ৬ আর উত্তরের ১৮ দশমিক ৮।

এর আগে এপ্রিল মাসে করা জরিপে দুই ওয়ার্ডের গড় বিআই ছিল ১৭ দশমিক ১৩। এর মধ্য উত্তরের গড় বিআই ছিল ১৬ দশমিক ৩৯ আর দক্ষিণের ছিল প্রায় ১৯। আর গত বছরের জুলাই মাসে ভরা বর্ষার সময় করা জরিপে দেখা যায়, দক্ষিণের ২৮ ওয়ার্ডে আর উত্তরের ২৮ ওয়ার্ডে বিআই ২০–এর বেশি ছিল।

শঙ্কার যে বিষয়

চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কমে আসে। এরপর জুলাই মাস থেকে তা বাড়তে থাকে। তবে প্রকোপ রোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত নভেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে ১৭৩ জন মারা যান। এ বছর কোনো মাসে এটি সর্বোচ্চ মৃত্যু। ডিসেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ এবং এতে মৃত্যু কমছে না। গতকালও ডেঙ্গুতে সাতজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২৯ জন। এর মধ্যে জরিপের এই ফল একটা শঙ্কা তৈরি করেছে।

জরিপে দক্ষিণ সিটিতে সবচেয়ে বেশি এডিসের লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর কারণ প্রসঙ্গে দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবিরের বক্তব্য, ‘এবার সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি নভেম্বর মাসেও বৃষ্টি হয়েছে। ফলে এডিস বংশবৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। আমরা অনেক কাজ করেছি মশা রোধে। কিছু করিনি, এমন কথা বলা ঠিক না।’

তবে এবারের বিলম্বিত জরিপ অন্তত আগামীর পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরেছে বলে মনে করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ডিসেম্বরে এসেও ডেঙ্গু কমছে না। রোগ এবং মশা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে। এটা শঙ্কার বিষয়। পরিস্থিতি সামলাতে জোরদার পদক্ষেপ জরুরি।’