ঢাকায় ডেঙ্গু রোগী আসতে মানা, তবু আসছে দুটি কারণে
আহসান ইসলাম রায়হানের বয়স ৬ বছর। গত শনিবার থেকে সে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর প্রথমে রায়হানকে কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এক দিন পরই সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন বলে জানালেন রায়হানের বাবা রহমতউল্লাহ।
মাদারীপুরের শিবচরে ফলের দোকান আমির হোসেনের। ছয় দিন আগে তাঁর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপরই তিনি মাদারীপুরের দুই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে গত পরশু ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীকে ঢাকা শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না আনার বা না পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছেন বাইরের রোগীরা। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও বেশ কয়েকজন রোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন যাঁরা ভর্তি আছেন, তাঁদের অনেকেই ঢাকার বাইরে অন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে চিকিৎসকেরাই তাঁদের ঢাকায় পাঠিয়েছেন। আবার অনেকে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ামাত্র ভয়ে নিজে থেকেই ঢাকায় চলে এসেছেন। এই দুটি কারণেই ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীরা আসছেন।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে আজ বৃহস্পতিবার ২২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও চাঁদপুর থেকে একজন করে এবং সাভার থেকে এসেছেন দুজন। এই হাসপাতালে বর্তমানে মোট ১০২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের কতজন, সেটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক জানাতে পারেনি।
শিশু হাসপাতালের নিচতলাতে দুটি ডেঙ্গু ওয়ার্ড। দুই ওয়ার্ডে মোট ১০০ শয্যা। সব শয্যাতেই রোগী ভর্তি। তাঁদের মধ্যে ৮ বছরের সিমি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে এসেছে। সিমির মা নিলুফার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালিয়াকৈরে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। এখানে নিয়ে আসতে বলেছে।’ তিনি জানান, মেয়ের চিকিৎসা, যাতায়াত সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮১০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৯৭৭ জন এবং ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৫ হাজার ৮৩৩ জন।
শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছয়টি শিশুর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, হাসপাতাল থেকেই ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নিয়মিত স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিরায় দেওয়ার স্যালাইন বাইরে থেকে কিনতে বলেনি। ফলে বাজারে স্যালাইনের সংকট জানলেও তাঁদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।
ডেঙ্গুর যে চিকিৎসা তাতে ১০০ রোগীর মধ্যে ২ জনের হয়তো ঢাকায় আনা লাগতে পারে। কিন্তু অনেকেই ভয়ে ঢাকায় চলে আসছেন। এতে বরং রোগীর ঝুঁকি বাড়ে।’
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের শিশু মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ফারহানা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বাইরে থেকেও ডেঙ্গু রোগী আসছেন। জানুয়ারি থেকে আজ পর্যন্ত ১ হাজার ৪১৬ ডেঙ্গু রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১৭ জন মারা গেছেন, যাঁদের অধিকাংশই ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছেন। রোগীর চাপ থাকায় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে। তবে শিশু হাসপাতালে সংকটের কোনো পরিস্থিতি হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার চেয়ে এর পাশের দুই নগর গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বেশি দেখা গেছে। এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় শিশু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্যে। তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ঢাকার বাইরের জেলা গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের রোগী বেশি এসেছেন।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ১৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ৮৫৭ জন আর ঢাকার বাইরে ২ হাজার ১৫৮ জন। বুধবার পর্যন্ত দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮১০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৯৭৭ জন এবং ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৫ হাজার ৮৩৩ জন। অর্থাৎ ঢাকার বাইরের রোগী অনেক বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর এত রোগী এবারই প্রথম দেখা গেল।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা সব জেলাতেই সমান
১৭ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু নিয়ে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে কথা বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবির। তিনি বলেন, অন্য জেলা থেকে ঢাকায় রোগী আনার সময় শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়ে পড়তে পারে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা সব জেলাতেই সমান। জেলাতে ডেঙ্গু রোগীর যে চিকিৎসা হবে, ঢাকার হাসপাতালেও একই চিকিৎসা পাবে। ঢাকায় রোগী এনে ঝুঁকি বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিনি বাইরের ডেঙ্গু রোগী ঢাকা শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না আনার বা না পাঠানোর অনুরোধ জানান।
তবে ঢাকার বাইরে থেকে রোগীরা ঢাকায় আসা বন্ধ হয়নি। মানিকগঞ্জের শিবালয় থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন ওমর ফারুক। তিনি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছিলেন। ফারুকের মামা মো. নাসির প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্বর কমতেছিল না। তাই উপজেলা থেকে ঢাকায় পাঠায় দিসে। ভাগিনার শরীরের অবস্থা ভালো না। ৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসছি।’
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এসেছেন মুজাহিদ মিয়া। ২২ বছরের এই যুবক চার দিন আগে এই হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর বড় ভাই শহীদ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুজাহিদের অনেক জ্বর ছিল। ডেঙ্গু ধরা পড়তেই ঢাকায় এসে হাসপাতালে ভর্তি করেছি।’
প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে থেকে বেশ কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন বলে জানান শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক খলিলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে রোগীরা বেশি আসছেন। ডেঙ্গুর যে চিকিৎসা তাতে ১০০ রোগীর মধ্যে ২ জনের হয়তো ঢাকায় আনা লাগতে পারে। কিন্তু অনেকেই ভয়ে ঢাকায় চলে আসছেন। এতে বরং রোগীর ঝুঁকি বাড়ে।’
যেসব রোগী ঢাকার বাইরের হাসপাতাল থেকে আসেন, তাঁদের অবস্থা কেমন থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাইরের হাসপাতাল থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের খুব কমসংখ্যকের অবস্থাই জটিল থাকে।