রোহিঙ্গাশিবিরে মা–শিশুর জীবন বাঁচায় হাসপাতালটি
প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছেন একজন। হুইলচেয়ারে বসিয়ে একজন সেবাদানকারী তাঁকে প্রসব কক্ষে নিয়ে যাচ্ছেন। ওই অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে হবু মা জানালেন, পঞ্চম সন্তানের জন্ম দিতে এসেছেন তিনি। পাশেই বসে ছিলেন বয়স্ক একজন নারী। কোলে কাথায় প্যাঁচানো ছোট্ট নাতনি। বললেন, তাঁর মেয়ের সন্তান। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনই ভালো আছে। দুই–এক দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরবেন।
এই দুই নারীর সঙ্গে কথা হয় হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেনের করিডোরে। কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই হাসপাতালটি অবস্থিত। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পরপরই হাসপাতালটি তৈরির উদ্যোগ নেয় হোপ ফাউন্ডেশন। পরের বছর ৫০ শয্যার এই হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়।
হাসপাতালের করিডোরে কথা হওয়া ওই দুই নারী ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন ও নির্যাতনের ফলে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। পরে কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া ৪ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে জায়গা পান তাঁরা।
হোপ ফাউন্ডেশনের হাসপাতালটিতে প্রসবসহ সব ধরনের সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যাচ্ছে এখানে। দেওয়া হয় পরিবার পরিকল্পনা সেবাও। আশ্রয়শিবিরটিতে অন্যান্য চিকিৎসাকেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের সুযোগ নেই।
হাসপাতালটিতে ২৫ জন চিকিৎসক, ২৬ জন নার্স, ১৯ জন মিডওয়াইফ এবং অন্যান্য পদে ১২০ জন কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। রয়েছে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। এই হাসপাতালে পুরুষ রোগীদের ভর্তি করা হয় না। তবে বহির্বিভাগে পুরুষ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছাড়াও হোপ ফিল্ড হাসপাতালে কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষদেরও সেবা দেওয়া হয়। এখানে যাঁরা সেবা দেন, তাঁদের মধ্যে স্থানীয় তরুণদের সংখ্যা বেশি। ফলে রোহিঙ্গা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে ভাষাগত সমস্যা তেমন হয় না। হাসপাতালটিতে নারীদের বিশ্রামাগারসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও আছে।
সংকটকালীন সেবা দেওয়ার জন্য খ্যাতি পেয়েছে হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন। পেয়েছে পুরস্কারও। ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল ফেডারেশন অ্যাওয়ার্ডস ২০২২–এ ‘সুলতানাত অব ওমান এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ফর হেলথ সার্ভিসেস ডিউরিং ক্রাইসিস’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছে। ৩৫টি দেশের মোট ৪০০ হাসপাতালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই পুরস্কার পেয়েছে হাসপাতালটি।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতর ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি সেবা দেওয়া একমাত্র হাসপাতাল এটি। বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে নারীরা সেবা নিতে এখানে আসেন। অনেক সময় শারীরিক জটিলতার কারণে অনেক প্রসূতির জরুরি অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হয়। এসব মা ও সন্তানের জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করছে হাসপাতালটি।
যাত্রা শুরুর গল্প
হোপ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু ১৯৯৯ সালে। ওই সময় দেশে ছোট্ট একটা ক্লিনিক পরিচালনার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিশুবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইফতিখার মাহমুদ। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে করোনার সময় আইসোলেশন সেন্টার চালু, স্থানীয় ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া, স্থানীয় মিডওয়াইফদের প্রশিক্ষণ, ফিস্টুলা অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন সেবা দেয় এই প্রতিষ্ঠান।
হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন চালু হয় ২০১৮ সালে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলসহ (ইউএনএফপিএ) বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তায় হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে। এই হাসপাতালের বাইরে হোপ ফাউন্ডেশন রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবায় আরও নয়টি প্রজনন স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেছে
আর হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন চালু হয় ২০১৮ সালে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলসহ (ইউএনএফপিএ) বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর আর্থিক সহায়তায় হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে। এই হাসপাতালের বাইরে হোপ ফাউন্ডেশন রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবায় আরও ৯টি প্রজনন স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করেছে।
হাসপাতালটির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের ভেতর ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া একমাত্র হাসপাতাল এটা। বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে নারীরা সেবা নিতে এখানে আসেন। অনেক সময় শারীরিক জটিলতার কারণে অনেক হবু মায়ের জরুরি অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হয়। এসব মা ও সন্তানের জীবন বাঁচানোর চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করছে হাসপাতালটি।
শওকত আলী আরও জানান, জটিল শারীরিক পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় অনেক প্রসূতিকে এই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন এসব রোগীদের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের হাসপাতালে রোগীদের পাঠানো হয়। যদিও এমন রোগীর সংখ্যা বেশ কম। গত ডিসেম্বরে এই হাসপাতালে ৯৫ জন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ও ১১৫ জন স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
যা দেখা গেল
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের লাল মাটির মধ্যে ছিমছাম করে সাজানো এই হাসপাতাল। গত ৩০ ডিসেম্বর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এখানে দুটি অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে। এর একটিতে অস্ত্রোপচার চলছে। সেখানে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন এক নারী। হাসপাতালটিতে আরও রয়েছে নিজস্ব ফার্মেসি ও ল্যাবরেটরি। ইসিজি, আলট্রাসাউন্ডসহ হাসপাতালটিতে ৫০টির বেশি পরীক্ষা করা হয়। গুরুতর অসুস্থ নবজাতককে বিশেষ পরিচর্যা দিতে আছে ৫ শয্যার একটি স্ক্যানু।
বর্তমানে হাসপাতালটিতে ২৫ জন চিকিৎসক, ২৬ জন নার্স, ১৯ জন মিডওয়াইফ এবং অন্যান্য পদে ১২০ জন কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। রয়েছে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। এই হাসপাতালে পুরুষ রোগীদের ভর্তি করা হয় না। তবে বহির্বিভাগে পুরুষ রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। হাসপাতালটির পাশেই আছে ৫০ শয্যার করোনা ইউনিট। এই ইউনিটে করোনা, ডেঙ্গু, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগীদের সেবা দেওয়া হয়।
হোপ ফিল্ড হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিয়েছেন মো. আলমের বোন। বোনকে দেখতে এসেছেন তিনি। মো. আলম বলেন, এর আগেও এই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর বোন সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সন্তানকে বাঁচানো যায়নি। তবে এবার মা–সন্তান দুজনই সুস্থ আছেন।
নবজাতকদের বিশেষ পরিচর্যাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তিনটি নবজাতককে বিশেষ সেবা দেওয়া হচ্ছে। দায়িত্বে থাকা চিকিৎসা কর্মকর্তা অর্ণব দাস প্রথম আলোকে বলেন, সন্তানসম্ভবা রোহিঙ্গা মায়েরা নানা জটিলতা নিয়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসেন। তাই অনেক সময় তাঁদের নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্তান নেওয়ার প্রবণতা বেশি। অনেক পরিবারে চার থেকে সাতটি সন্তানও রয়েছে। আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। কাউন্সেলিং করা হয়। অর্ণব দাস বলেন, শুরুর দিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কথা শুনতে একেবারে নারাজ ছিলেন বেশিরভাগ রোহিঙ্গা। এখন পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাচ্ছে। অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
রয়েছে সীমাবদ্ধতা
হোপ ফিল্ড হাসপাতালের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে নেই কোনো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ)। নেই ব্লাড ব্যাংক। এ ছাড়া সন্তান প্রসব ছাড়া আর কোনো অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা এই হাসপাতালে নেই।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সেবা দেওয়ার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে করছেন হাসপাতালটির চিকিৎসক–কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, শুধু পেশা নয়, অসহায় মানুষকে সেবার মনোভাব নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য কর্মক্ষেত্র হিসেবে এই জায়গা সবচেয়ে ভালো।
এই বিষয়ে শওকত আলী বলেন, এই হাসপাতালে যিনি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন, তাঁকেও কখনো কাজের কথা বলে দিতে হয় না। সবাই নিজের দায়িত্ব মনে করে হাসিমুখে সব কাজ করেন। প্রয়োজন হলে স্থানীয় রক্তদাতারা রক্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে ছুটে আসেন। জটিল পরিস্থিতি পার করে রোগীরা যখন সুস্থ হয়ে হাসিমুখে নিজ আবাসে ফিরে যান, সেটা বাড়তি আনন্দ দেয় সবাইকে।