প্রথম আলো: হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে। জলাবদ্ধতা না কমায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম একটি সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রীর ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
দেলোয়ার মজুমদার: স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর এই ক্ষোভ নগরবাসীর ব্যথা কিছু সময়ের জন্য হলেও লাঘব করবে। চট্টগ্রামের মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে মন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন, এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। তবে মন্ত্রী যদি নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন করতে পারতেন, তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকতাম।
প্রথম আলো: তাহলে জলাবদ্ধতা নিরসনে তদারকির ঘাটতি ছিল?
দেলোয়ার মজুমদার: চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পগুলো চলছে তিন মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিন সংস্থার তত্ত্বাবধানে। সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। মন্ত্রী তো চাইলে ‘ওয়ান-স্টপ সলিউশন’-এর মাধ্যমে সমন্বয়হীনতার ঘাটতি দূর করতে পারতেন। সিডিএর খনন করা খালগুলো যাতে সিটি করপোরেশন বুঝে নেয়, তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে সিটি করপোরেশনের জন্য বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী তা হয়নি। ফলে চট্টগ্রাম বারবার তলিয়ে গেছে।
মন্ত্রী কিন্তু আগেও চট্টগ্রামে সভা করে গিয়েছিলেন। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ কমার ব্যাপারে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তিনি যেসব কথা বলে গিয়েছিলেন, বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। এবার যেন কাজ হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, মন্ত্রী এখন সোচ্চার হয়েছেন। তাই আশা করি, আগামী বর্ষায় আমরা যাতে সুফল পাই, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা নির্দেশনা দেবেন মন্ত্রী।
প্রথম আলো: জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়েও মন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সিটি করপোরেশনের গাফিলতি নিয়ে যদি বলতেন।
দেলোয়ার মজুমদার: সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, এ কারণে সিটি করপোরেশন নগরের খাল ও বড় নালাগুলো পরিষ্কার করা থেকে বিরত ছিল। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন একটা অপরাধ করেছে। সেটি হচ্ছে নগরের যেসব রাস্তাঘাট ডুবে যেত, সেগুলো উঁচু করে ফেলেছে। ফলে দুই পাশের এলাকাগুলো নিচু হয়ে গেছে। রাস্তাগুলো এখন বাঁধ হিসেবে কাজ করছে। আর রাস্তা উঁচু করলেও পাশের নালাগুলো আর উঁচু করেনি। অনেক অলিগলির নালাও ঠিকভাবে পরিষ্কার করেনি। এতে নালাগুলো এখন আর পানি প্রবাহের উপযোগী নেই। ফলে পানি জমে থাকছে। আর সিটি করপোরেশনের নগরব্যাপী তদারকির জন্য জনবল রয়েছে। ফলে কোথায় পানি জমে থাকছে, কোথায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত সময়ের মধ্যে জানতে পারে। কিন্তু দ্রুত জানলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তা অপসারণের পদক্ষেপ নেয় না। আর নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে যেভাবে কাজ করার কথা, সিটি করপোরেশনের মধ্যে সে উদ্যোগ দেখা যায় না।
প্রথম আলো: এ বছর জলাবদ্ধতার যে পরিস্থিতি হয়েছে, তাতে কীভাবে আশা করা যায় আগামী বছর নগর পানিতে ডুববে না?
দেলোয়ার মজুমদার: চারটি প্রকল্পের অধীনে অনেকগুলো কাজ হয়েছে। কিন্তু কাজের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে যা করার ছিল, তা সেভাবে করা হয়নি। কাজে অনেক ঘাটতি ছিল। যেমন খালের পাড়ে প্রতিরোধ দেয়াল হয়ে গেছে। পাশে রাস্তার অবকাঠামো হয়েছে। কিন্তু প্রতিরোধ দেয়ালগুলো এখনো রাস্তা থেকে উঁচু। ফলে পানি নামতে পারেনি। আবার জোয়ার প্রতিরোধক ফটকের (রেগুলেটর) অবকাঠামো হয়ে গেলেও ফটক এখনো বসেনি। পাম্পের ঘর করা হয়েছে। পাম্প স্থাপন করা হয়নি। এখন এগুলো যদি আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে করা যায়, তাহলে মানুষ কিছুটা হলেও সুফল পাবে।
এ ছাড়া এখন থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে অর্থ, জনবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
প্রথম আলো: সক্ষমতা না থাকার পরও সিডিএকে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হলো। এটি কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে?
দেলোয়ার মজুমদার: এমন পরিস্থিতি সৃষ্ট হওয়ার জন্য সরকার কিন্তু দায় এড়াতে পারে না। কেননা, এমন একটি সংস্থাকে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাদের কখনো কোনো খাল বা নালা-নর্দমা থেকে একটি বোতল বা ময়লা অপসারণের অভিজ্ঞতাও ছিল না। প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা না থাকলেও সিডিএকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা প্রকল্পটি নিয়ে প্রথম এক বছর সময় নষ্ট করল। এরপর সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিল।
আর অভিজ্ঞতা না থাকার পরও এভাবে প্রকল্প নেওয়ার জন্য সিডিএকে দায় নিতে হবে। তারা যে প্রকল্প নিয়েছিল, সেখানে নগরের ড্রেনেজ সমস্যাকে পরিপূর্ণভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পটি ছিল খণ্ডিত, ত্রুটিপূর্ণ। নগরে বর্তমানে ৫৭টি খাল থাকলেও প্রকল্পে রাখা হয়েছে ৩৬টি। আর এই প্রকল্পটি প্রণয়নের সময় চট্টগ্রামের বাস্তব পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
আর পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও সেটির কোনো গতি নেই। সিটি করপোরেশন একটি নতুন খাল ১০ বছরেও শেষ করতে পারেনি। এখন যেভাবে খালটি খনন করছে, তাতেও পরিপূর্ণ সুফল আসবে না।
প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন, সিডিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মিলে ছয় বছরে ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। কিন্তু এখনো জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। উল্টো প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আর ব্যয় বাড়ছে। এমন অবস্থা কেন তৈরি হলো?
দেলোয়ার মজুমদার: আসলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংস্থাগুলোর দূরদর্শিতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তারা ত্রুটিপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়ন করেছে। যে কারণে বাস্তবায়ন করার পর্যায়ে এলে বারবার সংশোধন করতে হয়। এ ছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায় না। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সংস্থাগুলোর প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব রয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পের কাজ চললেও জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর হচ্ছে না।
প্রথম আলো: এখন জলাবদ্ধতার যে পরিস্থিতি, তাতে সংস্থাগুলোর করণীয় কী?
দেলোয়ার মজুমদার: আগামী বর্ষা মৌসুমে যাতে জলাবদ্ধতার সমস্যা কমে আসে, এ জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে সিডিএ ও সিটি করপোরেশনকে। বিশেষ করে রেগুলেটরগুলো অবশ্যই চালু করতে হবে। পাম্প মেশিন বসাতে হবে। যেসব প্রতিরোধ দেয়াল উঁচু রয়েছে, তা দিয়ে পানিনিষ্কাশনের প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের পাশাপাশি খাল ও নালাগুলো বর্ষার আগেই খনন করতে হবে। প্রয়োজনে বারবার খনন করতে হবে। একে অপরের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকলে হবে না। আর সিটি করপোরেশনকেও তার আওতাধীন সব নালা খনন ও পরিষ্কার করতে হবে। নতুন খাল খননের কাজও দ্রুত শেষ করার বিকল্প নেই। এসব কাজ করা গেলে আগামী বর্ষা মৌসুমে অন্তত ৫০-৬০ ভাগ জলাবদ্ধতা কমবে বলে আশা করি।