পাঠকের লেখা–৫০
পরম শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
আমি তখন বীরকুৎসা অবিনাশ দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সাল ১৯৭২। স্কুলের অবস্থান রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। আমাদের প্রধান শিক্ষক চয়েনউদ্দিন আহম্মেদ দক্ষ ও গুণী মানুষ ছিলেন। নবম ও দশম শ্রেণিতে সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিতের ক্লাস নিতেন। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে খেলাধুলা হবে। সে উপলক্ষে বাছাইপর্ব শেষ হয়েছে। একজন ছাত্র তিনটির বেশি খেলায় অংশ নিতে পারবে না।
চূড়ান্ত পর্বে আমিও যথানিয়মে তিনটি খেলায় অংশ নিই। সকাল ১০টা থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ক্রীড়া শিক্ষক খেলা পরিচালনা করছিলেন। একসময় সব ইভেন্টের খেলা শেষ হলো। প্রধান অতিথি হিসেবে তৎকালীন সংসদ সদস্য সরদার আমজাদ সাহেবের আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসতে পারলেন না। বিশেষ অতিথি, স্থানীয় বিশেষ ব্যক্তিত্ব ও প্রধান শিক্ষক মিলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার বিতরণ করলেন। বিশেষ অতিথি ও প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো। ছাত্রছাত্রীরা পুরস্কার পেয়ে আনন্দ করতে করতে যে যার বাড়ি চলে গেল। ভরা মাঠ অল্প সময়েই হয়ে গেল জনশূন্য।
আমি মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে প্রাইমারি স্কুলের পশ্চিম দিকে চুপচাপ বসে আছি। লাল সূর্য পশ্চিম দিগন্তে পাটে বসেছে। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ওই দৃশ্য আমি দেখছি। মনটা খুব খারাপ লাগছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। যারা অংশগ্রহণ করেছে, সবাই কোনো না কোনো একটি পুরস্কার পেয়েছে। আমি একমাত্র ছাত্র যে তিনটিতেই চতুর্থ হয়েছি। চতুর্থের জন্য তো কোনো পুরস্কার নেই।
ক্লাসে ৯১ জন ছাত্রের মধ্যে আমার রোল ছিল ১১ আর আবুল খয়েরের ছিল ৬৭। সে-ও একটা পুরস্কার পেয়ে আমাকে ইচ্ছা করে দেখিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে চলে গেল। তখনকার দিনে স্যাররা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে পড়া ধরত, না পারলে বেত্রাঘাত। প্রায় দিনই ইউনুস স্যার ওকে পড়া ধরতেন। ও পড়া পারত না এবং যথারীতি মার খেতো। সেই পড়া না পারা আবুল খয়েরও একটি পুরস্কার পেয়েছে। আমি কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছি না। এমন সময় আমার মাথার পেছনে অদৃশ্য হাত। ঘুরে দেখি চয়েনউদ্দিন স্যার।
‘স্যার, আমি তিনটিতে অংশ নিয়ে একটি পুরস্কারও পাইনি অথচ আবুল...।’ ‘তাতে কী! অনেকে অংশগ্রহণই করে না, তুমি তো অংশগ্রহণ করেছ। বাড়ি যাও, মন খারাপ কোরো না। সামনের বছর ভালোভাবে অনুশীলন করে অংশ নেবে।’ নিজের পকেট থেকে হোয়াইট ফেদার কলমের বাক্স বের করে স্যার আমাকে দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অনেকের চেয়ে ভালো ছাত্র। তোমার শিক্ষক বাবাকে আমার সালাম দিয়ো।’
অষ্টম-নবম শ্রেণিতে দু-একটি পুরস্কার পেলেও দশম শ্রেণিতে ওঠার পর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। সেবার আমি দুটিতে প্রথম ও একটিতে দ্বিতীয় হয়ে রানারআপ পুরস্কার পাই। সাধনা, চেষ্টা, অধ্যবসায় থাকলে মানুষ অনেক ভালো কিছু করতে পারে। সেদিন মনে হচ্ছিল, আমি যেন বিশ্ব জয় করেছি। আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।
আমরা যখন এক্স স্টুডেন্ট হয়ে ক্লাস করছি, তখন চয়েনউদ্দিন স্যার এসে যে অঙ্কগুলো এসএসসিতে আসার মতো, সেই অঙ্ক করতে দিতেন। বিশেষ করে বীজগণিতের অঙ্ক, যেখান থেকেই দিক না কেন, আমি সবার আগে অঙ্ক করে নিয়ে স্যারকে দেখাতাম। স্যার দেখে রাইট চিহ্ন দিতেন। আমি গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে আমার সিটে বসতাম। সে এক অন্য রকম আনন্দ।
এসএসসি পরীক্ষার আগে চয়েন স্যারের কাছে এক মাস প্রাইভেট পড়েছিলাম। বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান, মানসিক বুদ্ধিমত্তা, শৃঙ্খলা, সততা, সংহতি, বন্ধন ও ঐক্য, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা ওই বয়সে নতুন করে শিখেছিলাম। স্যার ক্রমেই আমার কাছে যেন নতুনভাবে উপস্থিত হতেন।
এই পড়ন্ত বেলায় নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ও যোগব্যায়াম করে শরীর ঠিক রাখতে চেষ্টা করছি। কিন্তু সময় তো কথা বলবেই। এই ৬৫ বছর বয়সে একটি দাঁত গেছে। বাকিগুলোও স্বস্তি দিচ্ছে না। বেশি শীত পড়লে ঢোঁক গিলতে কষ্ট হয়। পায়ের গোড়ালি মাঝেমধ্যে টন টন করে। এই সবকিছু নিয়ে বেশি ভালোই আছি আরকি!
ছাত্রজীবন, পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু স্যারের দেওয়া ওই কলম আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। আজও কলমটি যত্নে রেখে দিয়েছি। কাঁচা-পাকা দাড়িযুক্ত গুরুগম্ভীর, শার্ট ইন করে পরা, দৃঢ়চেতা শ্রদ্ধেয় চয়েনউদ্দিন স্যার আজও আমার চলার পথের পাথেয়। স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন, অন্তর থেকে জানাই শ্রদ্ধা।
নারায়ণ সরকার, আর বি সু মার্কেট, স্টেশন বাজার, নাটোর