তথ্যচিত্রে ফিরে দেখা
আগুনপাখির মতো আমার জেগে ওঠা
২০০৮ সালের ২০ জুন। প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশে সাতসকালে এক সহকর্মীর সঙ্গে তিনি যান তেজগাঁও শিল্পএলাকায়। কাজ শেষে অফিসে ফেরার সময় ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত হন। কাটা পরে তার দুই পা। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ জীবনে ফেরত আসেন। ২০১৩ সালে তাকে নিয়ে তৈরি করা হয় প্রামাণ্যচিত্র। বর্তমানে সাইফুল সামিন প্রথম আলোর সমন্বিত বার্তা বিভাগে জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক পদে কর্মরত। কেমন ছিল তাঁর সেই সময়কার গল্পটা?
ছোটবেলা থেকেই আমার ছুটে চলা স্বভাব। সেই আমি একদিন আচমকা থেমে গেলাম। তারপর ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে জেগে উঠলাম। আমার এই জেগে ওঠার গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রথম আলো।
প্রথম আলোর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরু মুগ্ধ পাঠক হিসেবে। ভালোবাসাটা পুরোনো, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়েই প্রথম আলোয় সাংবাদিকতা করার স্বপ্ন দেখি।
২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে স্বপ্নপূরণের আনন্দে ভাসি। প্রথম আলোর নগর সাময়িকী ‘ঢাকায় থাকি’তে আমার প্রথম প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রিয় পত্রিকার পাতায় প্রতিবেদক হিসেবে নিজের নাম দেখার অনুভূতি ছিল রোমাঞ্চকর।
তারপর জাদুর শহরের অলিগলি চষে বেড়িয়েছি। নগরবাসীর সমস্যা-সম্ভাবনা, হাসি-কান্না নিয়ে প্রতিবেদন সাজিয়েছি। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রদায়ক থেকে হয়েছি অ্যাসাইনমেন্ট রিপোর্টার। নিত্যনতুন সংবাদের নেশায় যখন ছুটে চলছিলাম, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার জীবন সম্পূর্ণ বদলে যায়। সাংবাদিকতার কাজে গিয়ে নিজেই ‘সংবাদ’ হয়ে গেলাম।
সেটি যেকোনো পাঠকের জন্য হৃদয়বিদারকই বলা যায়। প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘ট্রেনের নিচে পড়ে দুই পা হারালেন সম্ভাবনাময় তরুণ সামিন’ শিরোনামের সংবাদটি ছিল আমাকে নিয়েই।
২০০৮ সালের ২০ জুন সংবাদ সংগ্রহের জন্য তেজগাঁও গেলে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে আমার দুই পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমি তখন গল্পের এমন এক চরিত্র, যার প্রচণ্ড ছুটে চলা আচমকা থেমে গেল।
সঙ্গে থাকা সহকর্মী দুর্ঘটনার খবর দ্রুত অফিসে জানান। প্রথম আলোর তৎকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি সেখানকার চিকিৎসক আরিফ আনোয়ারকে ফোন করেন। চিকিৎসক আরিফ নিজের রক্ত দিয়ে আমার চিকিৎসা শুরু করেন।
হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর প্রথম বলেছিলাম, ‘আমি তো শেষ।’ এই মহাবিপন্ন সময়ে আমার পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো। সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সামনে এগিয়ে যেতে হবে, প্রথম আলো সব সময় পাশে থাকবে।’ অস্পষ্ট, দুর্গম যাত্রায় আমি যেন আলো খুঁজে পাই। পাই লড়াইয়ের সাহস।
প্রায় তিন মাস হাসপাতালে কাটে। হাসপাতালের সব খরচ প্রথম আলো বহন করে। প্রথম আলোয় আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় দুই বছর আমাকে প্রতি মাসে বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়।
হাসপাতাল ছাড়ার পর শুরু হয় কৃত্রিম পায়ের খোঁজ। উন্নত কৃত্রিম পা সংযোজনে অনেক টাকা দরকার। ঢাবির সাংবাদিকতা বিভাগ সহায়তা তহবিল খোলে, যার খবর প্রচার করে প্রথম আলো। অসংখ্য মানুষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।
অবশেষে ভারত-বাংলাদেশের একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান থেকে কৃত্রিম পা সংযোজনের সিদ্ধান্ত হয়। ৯ মাস ধরে চলে কৃত্রিম পা সংযোজনের এক কঠিন অধ্যায়। আমি যেন নতুন করে জন্মেছি। বারবার পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে শিখছি। একান্ত আপনজনের মতো আমার পাশে প্রথম আলো। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাই। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে বিরতি ছাড়াই স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করি।
চলতি বছরের আগস্টে প্রথম আলোয় আমার আনুষ্ঠানিক কর্মজীবনের এক যুগ পূর্ণ হয়েছে। জীবনের দীর্ঘ একটা সময় আমি প্রথম আলোর সঙ্গে। আর প্রথম আলো আমার সঙ্গে। আগুনপাখির মতো ‘ভস্ম’ থেকে আমার এই জেগে ওঠা, এগিয়ে চলা প্রথম আলোর অদম্য অগ্রযাত্রার গল্পেরই অংশ।