হঠাৎ বড়লোক হতে ক্রাইম প্যাট্রল দেখে আলিনাকে অপহরণ, মুক্তিপণ চাইতে না পেরে হত্যা
হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা জাগে ২০ বছর বয়সী যুবক আবির আলীর। এ জন্য অপরাধবিষয়ক ভারতীয় সিরিয়াল ‘ক্রাইম প্যাট্রলে’ আসক্ত আবির শিশু আলিনাকে অপহরণের পর ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করেন। আবির যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, আলিনা সে বাড়িরই মালিকের একমাত্র মেয়ে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আলিনাকে অপহরণও করেন আবির। কিন্তু মুক্তিপণ চাইতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। যে সিম ব্যবহার করে আবির আলিনার বাবাকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, সেটি ব্লক করা ছিল। পরিচিত নম্বর থেকে ফোন করলে পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন এমন ভয় ছিল তাঁর। তাই মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতেই শ্বাসরোধে হত্যার পর বস্তায় ভরে শিশুটির লাশ ভ্যানে করে নিয়ে যান আরেক বাসায়। পরে সেখানে কেটে ছয় টুকরা করে কিছু সাগরে আর কিছু খালের পাশে ফেলে দেন।
১১ মাস তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গতকাল রোববার চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র জমা দেয় আদালতে। চট্টগ্রাম আদালতে জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে নৃশংসভাবে শিশু আলিনা হত্যার বর্ণনা উঠে আসে। মামলার অভিযোগপত্রে মো. আবির ও তাঁর বন্ধু ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরকে (কিশোর বলে নাম উল্লেখ করা হলো না) আসামি করা হয়। মামলার কিশোর আসামির বিরুদ্ধে পৃথক দোষীপত্র দিয়েছে পিবিআই। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আবিরের বাবা আজহারুল ইসলাম, মা আলো বেগম ও তাঁর ১৭ বছরের বোনকে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানির জন্য এখনো তারিখ নির্ধারণ হয়নি।
আদালত সূত্র জানায়, আসামিদের মধ্যে আবির কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা জামিনে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক মনোজ কুমার দে আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, আবির ও তাঁর এক কিশোর বন্ধুর বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক অভিযোগপত্র ও দোষীপত্র দেওয়া হয়েছে। ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আলিনাকে অপহরণ করে লাশ ছয় টুকরা করার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তদন্তে। খুন করার পর যে জায়গায় লাশ ছয় টুকরা করা হয়েছিল, সেখান থেকে সংগৃহীত রক্ত ও লাশের টুকরার নমুনার সঙ্গে আলিনার মা-বাবার ডিএনএ পরীক্ষায় মিল পাওয়া গেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, আলিনা হত্যার শুরু থেকে লাশ উদ্ধার পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার গ্রাফিক চিত্র ধারাবাহিকভাবে তৈরি করেছে পিবিআই। এগুলো মামলার নথির সঙ্গে আদালতে দেওয়া হয়েছে।
সিরিয়াল দেখে অপহরণ
গত বছরের ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকার সোহেল রানার মেয়ে আলিনা নিখোঁজ হয়। ইপিজেড থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হলেও কোনো কিনারা হয়নি। পরে আলিনার বাবা পিবিআইয়ের কাছে যান। তারা ছায়া তদন্ত শুরু করে। ১০ দিন পর পিবিআই জানায়, পাঁচ বছরের শিশু আলিনাকে হত্যা করে ছয় টুকরা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আলিনাকে অপহরণ করেছিলেন তাদের বাসার ভাড়াটে আবির। আবিরের বাবা ভ্যানচালক আজহারুল ইসলাম। তাঁরা আলিনাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন।
২৫ নভেম্বর আবিরকে পিবিআই গ্রেপ্তারের পর তিনি হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পিবিআইয়ের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, জবানবন্দিতে আবির ভারতীয় সিরিয়াল দেখে এমন পরিকল্পনা করার কথা জানিয়েছেন। আবির পিবিআইকে বলেন, শিশু আলিনাকে হত্যার পর আবির লাশ তাঁদের ভাড়া বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। এরপর নিজেই আলিনার মা-বাবার সঙ্গে মিলে আলিনাকে খুঁজতে থাকেন। এর আগেও তিনি কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাসার আশপাশের লোকজন থাকায় কিছু করতে পারেননি।
হতাশা আর লোভ
আলিনার জন্মের আগ থেকে তাদের বাসায় ভাড়া থাকেন আবিরের মা-বাবা। খুনের কারণ সম্পর্কে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা আবির জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া লেগেই ছিল। আলিনা হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিচ্ছেদের পর মা অন্য বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। আর আবির থাকতেন বাবার সঙ্গে। এর মধ্যে করোনার সময় মায়ের চাকরিও চলে গিয়েছিল। এরপরও আবির পরিবারের জন্য কিছু করতে পারছিলেন না। এসব হতাশা এবং বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা থেকে তিনি এমনটা করেছেন। তিনি ২০ লাখ টাকা দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে ভাড়া দেবেন বলে চিন্তা করেন। তাই আলিনাকে খুন করে এ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেন।
কুড়িয়ে পাওয়া মুঠোফোনের সিম কাজ করেনি
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মায়ের সেলাই মেশিন বিক্রি করে পাওয়া টাকা থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে একটি মুঠোফোন কেনেন আবির। এর কিছুদিন আগে রাস্তায় একটি সিম কুড়িয়ে পান তিনি। পরিকল্পনা ছিল, কুড়িয়ে পাওয়া সিম ব্যবহার করে আলিনার বাবাকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করবেন।
১৫ নভেম্বর ঘটনার দিন মক্তবে পড়তে যাওয়ার সময় আলিনাকে তাদের ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। এরপর মুঠোফোনে কুড়িয়ে পাওয়া সিম ঢুকিয়ে ফোন করতে গিয়ে দেখেন সেটি ব্লক করা। এ অবস্থায় আলিনাকে ছেড়ে দিলে সে সবকিছু জানিয়ে দেবে। আবার তাকে রাখবেন কোথায়—এই চিন্তা থেকেই খুন করেন।
পরে বাসার অন্য মালামালের সঙ্গে একটি ব্যাগ ভর্তি করে আলিনার লাশ পাশের আকমল আলী রোডে মায়ের ভাড়া বাসায় নিয়ে আসেন। এ সময় আবিরের মা বাসায় ছিলেন না। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবিরের মা-বাবা আলাদা থাকছিলেন।
আবির লাশটি মায়ের বাসায় শৌচাগারের ওপর জিনিসপত্র রাখার জায়গায় লুকিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার পর তিনি আলিনাদের বাসায় গিয়ে তাকে খুঁজতে থাকেন। এরপর বাসায় ফিরে আলিনাকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মা ও বোনকে আলিনার বাসায় পাঠান। এরপর তিনি লাশটিকে ছয় টুকরা করে পলিথিনে ভরে রাখেন। পরদিন নগরের বন্দরটিলা বে টার্মিনাল সাইনবোর্ড এলাকায় ও আকমল আলী ঘাট স্লুইসগেট এলাকায় খণ্ডিত লাশ ফেলে দেন। গত বছরের ৩০ নভেম্বর বন্দরটিলা আকমল আলী ঘাটসংলগ্ন স্লুইসগেট এলাকা থেকে দুটি পা এবং পরদিন একই এলাকা থেকে আলিনার মাথাসহ ছয় টুকরা উদ্ধার করে পিবিআই।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর আবির আমাদের জানিয়েছেন, নিজে যাতে ধরা না পড়েন সে জন্য মামলার আলামত লাশের টুকরাগুলো সরিয়ে রাখেন। ছোটবেলা থেকে ক্রাইম প্যাট্রল আর সিআইডি দেখতেন। কীভাবে অপরাধ করলে ধরা পড়বেন না, আলামত কীভাবে ধ্বংস করতে হবে, সে কৌশল পুরোপুরি রপ্ত করা আছে তার। খুনের পর পালিয়ে না যাওয়ার কারণ হিসেবে জানিয়েছে, পালিয়ে গেলে সবাই তাকে সন্দেহ করত।
আবিরের ফাঁসি চায় আলিনার পরিবার
শিশু আলিনার বাবা সোহেল রানা আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো দিন ভাবিনি, আবির আমার মেয়েকে খুন করবে। তাকে (আবির) চাচ্চু বলে ডাকত মেয়েটা। কীভাবে তার লাশ ছয় টুকরা করল? একটাই চাওয়া, আবিরের ফাঁসি।’
আসামির ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের জন্য মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানান আলিনার দাদা মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, এতে অপরাধীরাও বুঝতে পারবে যে অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।